বাংলা নববর্ষ উদযাপন

লোকজ সংস্কৃতিসহ থাকবে ফ্যাসিবাদের মোটিফ

প্রকাশিত: ১১ এপ্রিল ২০২৫ ০৭:০৪ এএম

বৈশাখকে বরণ করে নিতে রংতুলির আচঁড়ে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদ। বাংলা নববর্ষ-১৪৩২-এর শোভাযাত্রা ও এই আয়োজনকে ঘিরে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। ইতোমধ্যে মুখোশসহ বিভিন্ন উপকরণ ও শোভাযাত্রার মোটিফ প্রস্তুতের কাজ প্রায় ৮০ ভাগ শেষ হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি শেষ হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জুলাই বিপ্লবের পর প্রথমবারের মতো পালিত হচ্ছে বাংলা নববর্ষ। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে সামনে রেখে এবার নববর্ষের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’। এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এবারকার প্রধান মোটিফ থাকছে ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’, যার উচ্চতা ২০ ফুট। এই মোটিফে বাঁশ ও বেত দিয়ে দাঁতাল মুখের এক নারীর মুখাবয়ব দেখা যায়। মাথায় খাড়া চারটি শিং, হা করা বিকৃত মুখ, বিশালাকৃতির নাক ও ভয়ার্ত দুটি চোখ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবারার শোভাযাত্রায় ফ্যাসিবাদের ‘বিভৎস মুখাকৃতি’-সহ বড় আকারের মোটিফ থাকবে ছয়টি। এর মধ্যে রয়েছে কাঠের বাঘ, ইলিশ মাছ, ৩৬ জুলাই (টাইপোগ্রাফি), শান্তির পায়রা ও পালকি। এ ছাড়াও মাঝারি আকারের মোটিফের মধ্যে থাকবে সুলতানি ও মোগল আমলের শাসকদের মুখোশ, তালপাতার সেপাই, রঙিন চরকি, পাখা, ঘোড়া, তুহিন পাখি ও শতফুট উচ্চতার লোকজ চিত্রাবলির ক্যানভাস। ছোট মোটিফ হিসেবে ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি রয়েছে ৮০টি। এ ছাড়াও লোকজ সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বাঘের মাথা ২০০টি, পলো, মাছের চাঁই, মাথাল, লাঙল ও মাছের ডোলা থাকবে।

এসবের পাশাপাশি মীর মুগ্ধের স্মৃতি স্মরণ করে একটি পানির বোতল ও আবু সাইদের দুই হাত প্রসারিত অবস্থায় আরেকটি মোটিফ বানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে কর্তৃপক্ষ।

শোভাযাত্রায় ফ্যাসিবাদের মোটিফ প্রসঙ্গে গ্রাফিক্স ডিজাইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইসরাফিল রতন বলেন, এবারকার প্রতিপাদ্যের সঙ্গে মিল রেখে মোটিফ নির্বাচন করা হয়েছে। কোনো ফ্যাসিবাদ যেন এ দেশে আর ফিরতে না পারে, সেজন্য এটিকে গুরুত্ব দিয়ে ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতিকে মোটিফ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও শুরুতে মীর মুগ্ধের বোতলের মোটিফ বানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও পরে তা বাতিল করা হয়।

এদিকে চারুকলার নববর্ষ উদযাপন ও শোভাযাত্রার অর্থ সংগ্রহের জন্য চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বরেণ্য শিল্পীদের দিয়ে বানানো বিভিন্ন চিত্র ও শিল্পকর্ম বিক্রি চলছে। গত ২০ মার্চ একটি কর্মশালার মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। সরা, জলরং, মুখোশসহ নানা শিল্পকর্ম রয়েছে এতে। এ ছাড়াও ১২ এপ্রিল পর্যন্ত মোটিফ, প্রতিকৃতি ও শিল্পকর্ম বানানোর কার্যক্রম চলবে। এরপর ১২ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত চারুকলার বারান্দায় শুধু ঐতিহ্যবাহী মোটিফ প্রদর্শনী ও বিক্রয় করা হবে। এ ছাড়া ১৩ এপ্রিল চৈত্রসংক্রান্তি পালন করবে চারুকলা। চারুকলার অভ্যন্তরে নাগরদোলা, চরকি, পুতুলনাচ, বায়োস্কোপ ও বৈশাখী খাবারে দোকান থাকবে। পাশাপাশি বকুলতলায় বৈশাখ উপলক্ষে দুদিন যাত্রাপালার আয়োজন করা হবে।

এ বিষয়ে দায়িত্বরত চারুকলা অনুষদের শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক তাসলিমা বেগম বলেন, গত ২০ মার্চ থেকে আমরা এ কার্যক্রম শুরু করি। মাঝে রমজান ও ঈদ থাকায় শিল্পকর্মগুলো খুব বেশি বিক্রি হয়নি। তবে এই বিক্রি শেষ সময়ে এসে কিছুটা বাড়তে পারে।

চারুকলার সিনিয়র শিক্ষক ও বরেণ্য শিল্পীদের বানানো পেইন্টিং বানানোরও কাজ চলছে। এসব শিল্পকর্ম ভালো দামেই বিক্রি হয় বলে জানান তাসলিমা বেগম।

সরেজমিন দেখা যায়, বাংলা বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে শিক্ষকসহ চারুকলায় বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। সন্ধ্যা হলে চারুকলার সাবেক শিক্ষার্থী ও শিল্পীরা এসে কাজে লেগে পড়েন। শুরুতে শিক্ষার্থীরা এ বছর কাজে যুক্ত না হলেও ঈদপরবর্তী সময়ে পূর্ণোদ্যমে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রথমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি ভুল বোঝাবুঝি হলেও পরে সেটির অবসান হয়। এমনটি জানিয়ে অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবদুস সাত্তার বলেন, প্রতি বছর মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা এটার আয়োজনের দায়িত্বে থাকে। এবার শুরুতে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি হয়। শিক্ষার্থীরা এটা নিয়ে কথা ওঠালে পরে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটে। বর্তমানে সব ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এ আয়োজনকে সফল করতে দিনভর কাজ করে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে গ্রাফিক্স ডিজাইন বিভাগের ৩০ ব্যাচের শিক্ষার্থী অন্তর বিশ্বাস বলেন, আমরা নববর্ষের এই দিনটির জন্য বছরজুড়েই অপেক্ষা করি। আমরা এখানে নিজেদের ইচ্ছামতো কাজগুলো করতে পারি। যার যেভাবে ভালো লাগে সেভাবে ডিজাইন করে। তাতে কোনো বাধা নেই। সত্যি বলতে, আমরা এখানে মজা নিয়ে কাজগুলো করে থাকি।

জানা যায়, এবার শোভাযাত্রা চারুকলা থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ যাবে। সেখান থেকে টিএসসি হয়ে শহীদ মিনারের দিকে যাবে। পরে দোয়েল চত্বর ও বাংলা একাডেমি হয়ে ফের চারুকলায় এসে শেষ হবে।

সার্বিক বিষয়ে চারুকলা অনুষদের ডিন ও নববর্ষ উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আজহারুল ইসলাম চঞ্চল বলেন, ইতোমধ্যে প্রস্তুতির প্রায় ৮০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কাজ দ্রুতগতি ও সফলতার সঙ্গে এগোচ্ছে।

এ বছর শোভাযাত্রায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এ বছর শোভাযাত্রায় দেশের শিল্প, সংস্কৃতি ও ভাষা সবগুলোকে উপস্থাপনের চেষ্টা করছি। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও শ্রেণির সংস্কৃতি উপস্থাপন করা হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, সার্বিক প্রস্তুতি শেষের পথে। নিরাপত্তাসহ সার্বিক বিষয়ে আমরা সর্বদা সচেতন রয়েছি। সুন্দর একটি পহেলা বৈশাখের জন্য অপেক্ষা করছি আমরা।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর