গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ১০ নারীর গল্প
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। চলতি দশকে কোনো আন্দোলনে রাজপথে নারীদের এমন স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি দেখা যায়নি। মাঠে উপস্থিত থাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে কলাকৌশল সমন্বয়সহ সবখানে অবদান রেখেছেন নারীরা।
শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি আদায়ে অহিংস আন্দোলনের বিপরীতে সরকারের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালাতে শুরু করলে নারী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে পোশাককর্মী, গৃহিণী, মা, চিকিৎসক, নার্সসহ সব পেশাজীবী নারী রাস্তায় এক কাতারে সমবেত হন। স্বৈরাচারের পতন পর্যন্ত তারা আন্দোলনে রাজপথ ও অনলাইনে সক্রিয় ছিলেন।
একদিকে যেমন নারীরা মাঠে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সুসংগঠিত করেছেন শিক্ষার্থীদের; তেমনি চিকিৎসক-নার্সরা আহত ছাত্র-জনতাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন, কর্মজীবী ও গৃহিণী মায়েরা রাস্তায় পানি খাইয়েছেন। গত বছর ডিসেম্বরে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় তাদের এক প্রতিবেদনে ১১ জন নারী শহীদের কথা উল্লেখ করলেও এই লেখা তৈরি করতে গিয়ে আমরা ১০ জনের পরিচয় শনাক্ত করতে পেরেছি।
১. নাঈমা সুলতানা
নাঈমা সুলতানার বয়স ১৬ বছর; ছিল মাইলস্টোন স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার অবসর কাটতো আঁকাআঁকিতে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরুতে বাসায় বসে বসে খাতায় নানা স্লোগান সংবলিত প্রতিবাদী ছবি এঁকে সময় পার করেছে। মারা যাওয়ার আগের দিন—১৮ জুলাই ২০২৪—উত্তরায় পুলিশের গুলিতে প্রায় ৩০ জন ছাত্র-জনতা মারা যায়। ওইদিন রাতে নাঈমা আন্দোলনের পোস্টার আঁকছিল, আর মায়ের সঙ্গে গল্প করছিল। একপর্যায়ে মাকে বলে, 'আম্মু, ধরো আমি যদি আন্দোলনে গিয়ে মারা যাই, তুমি মানুষকে কী বলবা?'
মাকে জবাব দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে আবার নিজেই বলে ওঠে, 'বলবা যে শহীদ হয়েছে। আমার মেয়ে শহীদ হয়েছে।'
নাঈমার বাবা বলেন, 'ওর মা তখন নাকি বলছিল, এসব তুমি কী বল, মা! আমরা তোমাকে বড় করছি ভালো কিছু করার জন্য। এসব আর বলো না। তুমি মারা যাবে কেন!'
উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে একটা বাসায় ভাড়ায় থাকত নাঈমারা। তাদের তিন ভাই-বোনকে নিয়ে মা থাকেন এ বাসায়। বাবা পল্লী চিকিৎসক, গ্রাম থেকে যাওয়া-আসার মধ্যে থাকেন। ভবনের চারতলায় থাকেন তারা।
১৯ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার। তাদের বাসার একটু দূরে উত্তরা আধুনিক মেডিকেলের সামনে ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশ ও তাদের সহযোগী ছাত্রলীগ-যুবলীগের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধলে অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ও কিছু পুলিশ আশপাশের গলিতে ঢুকে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। বিকেল আনুমানিক ৪টা। নাঈমা তার রুমে বসে 'বয়কট ছাত্রলীগ', 'কোটা সংস্কার চাই'সহ নানা স্লোগানে রঙিন কালিতে প্রতিবাদী পোস্টার আঁকছিল। আঁকাআঁকি থেকে উঠে মাকে জিজ্ঞেস করে, 'আম্মু, পিৎজা বানাবো। ফ্রিজে কী চিকেন আছে?'
মা হ্যাঁ বলায় সে বলে, 'আচ্ছা একটু পর বানাবো। বারান্দায় যাই একটু।' (সম্ভবত কাপড় আনতে বলছিল। বাবা স্মরণ করতে পারেননি, কী বলেছিল মাকে)। এ অবস্থায় বাসার সামনে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে দৌঁড়ে বারান্দায় আসে দেখতে। তার বাসার নিচে তখন আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি ছুঁড়ছিল। তখন হাতে থাকা মোবাইলে ভিডিও অন করে নিচের দিকে তাক করতেই তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে পুলিশ। গুলির আঘাতে মুহূর্তেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে নাঈমা।
নাঈমার মাথার একপাশ দিয়ে গুলি ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। মেঝেতে মগজ ছিটিয়ে পড়ে। গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে সে শুধু একটাই শব্দ করতে পেরেছিল, 'মা...আ...!'
পেছনে রুমে থাকা মা ও বড় বোন তার শেষ শব্দটি শুনে 'কী হইছে' বলে দৌঁড়ে বারান্দায় এসে দেখে, নাঈমা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ছে। মাথা দিয়ে রক্ত ঝরছে। সারা বারান্দায় ছড়িয়ে গেছে তার রক্ত।
মেয়ের এ অবস্থা দেখে মা জ্ঞান হারান। বোনের কান্নার আওয়াজে আশপাশের ফ্ল্যাট ও নিচে থাকা ছাত্ররা এসে ধরাধরি করে নাঈমাকে নিয়ে যায় উত্তরা আধুনিক মেডিকেলে। কিন্তু তার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় নাঈমা।
রাতেই নাঈমার মরদেহ নেওয়া হয় গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উত্তরের আমুয়াকান্দা গ্রামে। পথে পুলিশের নানা হয়রানির শিকার হতে হয় তাদের। কোথা থেকে এসেছে এ মরদেহ, কীভাবে মারা গেছে, কোথায় যাচ্ছে—নানা প্রশ্ন। পরদিন সকাল সাড়ে ৯টায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় নাঈমাকে।
নাঈমা ছিল মেধাবী। বাবার বর্ণনা, 'আমার মেয়েটা পড়ালেখায় খুব ভালো ছিল। বড় হয়ে ডাক্তার হতে চাইছিল। কোটা আন্দোলনে বাসা থেকে বের হতে ওর আম্মু নিষেধ করলে সে বাসায় বসে প্রতিবাদী ছবি আঁকতো। সেসব আবার ফেসবুকেও শেয়ার করতো। ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে মোবাইলে কল দিয়ে বান্ধবী ও ম্যাডামদের কাছে জেনে রেখেছিল, ওরা কোথায় আন্দোলনে থাকবে। যাতে পরদিন ও বের হতে পারে।'
২. রিয়া গোপ
মাত্র সাড়ে ৬ বছর বয়স ছিল রিয়া গোপের। বেঁচে থাকলে এ বছর সাতের কোটায় পা দিত। স্কুলে মাত্র যাওয়া-আসা শুরু করেছিল। নারায়ণগঞ্জ সদরের নয়ামাটি এলাকায় তাদের বাসস্থান। পাঁচতলা ভবনের সবার ওপরের তলায় থাকতো তারা। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই ছিল শুক্রবার। ঢাকাসহ সারাদেশ উত্তপ্ত। সারাদেশে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলন চলছে। এদিন সকাল থেকেই তাদের বাসার সামনের ডিআইটি নামক স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের বেশ কয়েকবার ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে। বাসার সবাই বেশ কিছুক্ষণ ছাদ থেকে সেসব দৃশ্যও দেখেন। দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় সবাই ছাদ থেকে নেমে বাসায় চলে আসে। খাওয়া-দাওয়া শেষে আবারও বাড়ির অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে ছাদে খেলতে যায় রিয়া।
দুপুর নাগাদ আবারও তাদের বাসার সামনের রাস্তায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এবার আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে হেলিকপ্টার থেকে টিয়ারগ্যাস ও গুলি ছোড়া হয়। অতিরিক্ত চিৎকার-চেঁচামেচি ও গুলির আওয়াজ শুনে বাবা দৌঁড়ে যান ছাদে—মেয়েকে ঘরে আনতে। এরইমধ্যে লক্ষ্য করেন, রাস্তার আন্দোলনকারীদের দিকে মাথার ওপর থেকে হেলিকপ্টার থেকে টিয়ারগ্যাস ও গুলি ছোঁড়া হচ্ছে। মেয়েকে বাসায় আনতে কোলে নিলেন। ঠিক তখনই মেয়ের মাথায় একটা গুলি এসে লাগে। মুহূর্তেই বাবার কোলে ঢলে পড়ে রিয়া। আকস্মিক এই পরিস্থিতিতে স্তব্ধ হয়ে যান বাবা।
'বাসার ছাদে নিজের কোলে মেয়ের গায়ে এসে গুলি লাগে। কিছু বলার থাকে? সেই পরিস্থিতি বুঝানোর ভাষা নেই। এখন আর নতুন করে স্মরণ করতে চাই না সেই সময়টা। একমাত্র মেয়ে। এ বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছি।'
দৌঁড়ে মেয়েকে নিয়ে বাবা ছোটেন বাসার সামনের জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে প্রাথমিকভাবে চেষ্টা করা হয় ব্লিডিং বন্ধ করতে। এরইমধ্যে মেয়েটির অবস্থা শোচনীয় হতে থাকলে জেনারেল হাসপাতাল থেকে বলা হয় দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে। তখনো অনবরত তার মাথা দিয়ে রক্ত ঝরছে। বাবা মেয়েকে নিয়ে ছোটেন ঢামেকের উদ্দেশ্যে। ঢামেকে ডাক্তাররা জানান, অপারেশন করতে হবে। মাথার গুলিটা বের না করলে অবস্থার আরও অবনতি হবে।
রিয়াকে আইসিইউতে ভর্তি করানো হলো। সে রাতেই মাথায় অপারেশন করা হলো। ডাক্তাররা জানান, ৭২ ঘণ্টা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে, তারপর পরিস্থিতি বোঝা যাবে। এরইমধ্যে একদিন পার হয়। রোববার সকালে রিয়াকে কিছুটা নড়াচড়া করতে দেখলে ডাক্তাররা আশ্বাস দেন, পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাবে। পরিবারের সদস্যরাও আশা পান। আরও দুদিন কেটে যায় আইসিইউতে। বুধবার তাদের আশায় নেমে আসে বিষাদ! সবাইকে কাঁদিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে নেয় ছোট্ট রিয়া।
রিয়ার বাবা দীপক কুমার গোপ স্থানীয় একটি রড-সিমেন্টের দোকানে ব্যবস্থাপক পদে কাজ করেন। মা গৃহিণী। পাঁচ বছর পর তাদের কোল জুড়ে এসেছিল রিয়া। খুবই হাসিখুশি ছিল। দুষ্টুমিতে সবাইকে মাতিয়ে রাখতো। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সবার আদুরে ছিল রিয়া।
৩. নাফিসা হোসেন মারওয়া
নাফিসা হোসেন মারওয়ার বয়স ছিল ১৭ বছর। উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী ছিলেন। পড়তেন টঙ্গীর সাহাজউদ্দিন সরকার উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে যখন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে, তখন নাফিসা ও তার কয়েকজন বান্ধবী মেসেঞ্জারে গ্রুপ খুলে আলোচনা করে প্রতিদিন রাস্তায় বের হত। রাজপথে নেতৃত্ব দিতো নাফিসা।
নাফিসার বাবা চা দোকানদার। পরিবার নিয়ে থাকেন টঙ্গীতে একরুমের ছোট্ট ভাড়া বাসায়। বাসা থেকে একটু দূরে দোকান। প্রতিদিন ভোরে চলে যান দোকানে, ফেরেন রাত ১০-১১টায়। বাবা বাসায় ফেরার আগেই নাফিসা চলে আসতো বলে আন্দোলনে যাওয়া নিয়ে কিছুই জানতেন না তিনি। বছর দুয়েক ধরে মা কুয়েতে। একমাত্র ছোট বোন থাকে সাভারে নানুর বাসায়। নাফিসা পড়ালেখার জন্য বাবার কাছে থাকলেও সাভারে মামাদের বাসায় নিয়মিত ছিল তার যাওয়া-আসা। বেশিরভাগ সময় থাকত ওখানেই।
বাবা একদিন প্রতিবেশীর কাছে মেয়ের আন্দোলনে যাওয়ার কথা জানতে পেরে বাসায় ফিরে তাকে বকাঝকা করেন। এর মধ্যে ২০২৪ সালের ২৮ জুলাই মেয়ে বলে, সাভারে মামার বাসায় যাবে। যেহেতু আন্দোলনের কারণে উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেছে, বাবা বাঁধা দিলেন না। সেখানে মামারা হয়তো আন্দোলনে যেতে দেবেন না, এ চিন্তা করলেন।
বাবার অনুমতি পেয়ে প্রথম ২৮ জুলাই ধামরাইয়ে বড় মামার বাসায় যায় নাফিসা। সেখান থেকে ৩০ জুলাই সাভারে ছোট মামার বাসায় যায়। সেখানে গিয়েও ফোনে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রতিদিন আন্দোলনে চলে যেত। মামারা নিষেধ করলেও শুনতো না। ৩ আগস্ট বিকেলে আন্দোলনে থেকে একটা সেলফি তুলে বাবাকে পাঠায়। ছবি দেখে বাবা রেগে যান। মোবাইলে কল দিয়ে মেয়েকে বকাঝকা শুরু করেন। 'তোরে আমি ওইখানে পাঠাইলাম নিরাপদে থাকার জন্য, তুই রাস্তায় গেলি ক্যান।'
বাবার বকা শুনে ওইদিন দুপুর সাড়ে ৩টার দিকে ফিরে আসে মামার বাসায়।
৫ আগস্ট সকালে আবারও বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। এবার ছোট মামা কোনোভাবে বের হতে দেবেন না; কিন্তু সে যাবেই যাবে। শেষ পর্যন্ত মামাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নাফিসা বাসা থেকে বের হয়ে সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেয় লংমার্চে। এরইমধ্যে মামা মোবাইলে কথা বলে দ্রুত বাসায় ফিরতে বলেন।
দুপুর আড়াইটার দিকে নাফিসা বাবাকে কল দিয়ে বলে, 'আব্বু, হাসিনা পলাইছে।' বাবা রাগত স্বরে বলে ওঠেন, 'হাসিনা পলাইছে, তোর বাপের কী! তোর বাপ হইল চা দোয়ানদার। তোর কিছু হইলে কে দেখবো!'
নাফিসা বাবাকে আশ্বস্ত করে, 'আর কিছু হবে না, আব্বু। হাসিনা পলাই গেছে। ভার্সিটির বড় ভাইয়া-আপুদের সঙ্গে আছি।'
বাবা কড়া নির্দেশ দেন, 'তাড়াতাড়ি বাসায় যা।'
নাফিসার জবাব আসে, 'আর পেছনে ফিরে যাওয়ার সময় নাই, আব্বু। আল্লা যা কপালে রাখছে তা হবে।'
বাবার সঙ্গে কথা বলার কয়েক মিনিট পরে ওদের দলটি যখন সাভার মডেল মসজিদ এলাকা দিয়ে আগাচ্ছিল, শুরু হয় পুলিশ-ছাত্রলীগ-যুবলীগের যৌথ হামলা। পুলিশ ছত্রভঙ্গ করতে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে। মিছিলের সামনে থাকায় গুলিবিদ্ধ হয় নাফিসা। তাকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় ল্যাবজোন হাসপাতালে।
এরইমধ্যে বাবা একবার কল দেন। বাসায় ফিরছে কি না, তা জানতে। কিন্তু কল রিসিভ হয় না। কিছুক্ষণ পর আবার বাবার নম্বরে কল আসে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা ছেলের কণ্ঠ শোনা যায়, 'আপনি ওর কী হন?'
'বাবা।'
'তাড়াতাড়ি ল্যাবজোন হাসপাতালে আসেন। ওর গায়ে গুলি লেগেছে।'
আচমকা এমন সংবাদে দিশেহারা হয়ে যান তিনি। কিছুক্ষণ আগেও মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। সে তো বলেছে হাসিনা পলাইছে, এখন কী হলো!
কিছু বুঝে উঠতে না পেরে কল দিতে থাকেন নাফিসার নানী ও মামাদের। কিন্তু সংযোগ করতে পারছেন না। দোকান বন্ধ করেই ছোটেন সাভারের উদ্দেশে। রাস্তায় তেমন গাড়ি নেই। ভেঙে ভেঙে রিকশা নিয়ে যেতে থাকেন। এদিকে মামাদের মোবাইলে সংযোগ করতে না পেরে কুয়েতে থাকা স্ত্রীকে (নাফিসার মা) কল দিয়ে বলেন, 'তাদের সবার ফোন কেন বন্ধ। নাফিসার গায়ে গুলি লেগেছে, তাড়াতাড়ি বলো ল্যাবজোন হাসপাতালে যাইতে।'
এরমধ্যে মামারাও খবর পেয়ে ছুটে যান ল্যাবজোন হাসপাতালে। সেখান থেকে নাফিসাকে নিয়ে যাওয়া হয় এনাম মেডিকেলের দিকে। পথে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে নাফিসা।
এনাম মেডিকেলে আনার পরও তার ব্লিডিং বন্ধ করা যাচ্ছিল না। মেডিকেল থেকে মরদেহ নিয়ে ফেরার পথে মুক্তির মোড়ে আরেক দফায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলার শিকার হয় তার মামারা। পুলিশের রাবার বুলেটে আহত হন এক মামা। পরে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় অ্যাম্বুলেন্সে বিকেল সাড়ে ৪টার পর নাফিসার মরদেহ নিয়ে আসা হয় মামার বাসায়। সাভারে রাত ৯টায় প্রথম জানাজা শেষে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় টঙ্গীতে বাবার এলাকায়। এরশাদনগরে পৈতৃক ভিটা-মাটিতে দাফন করা হয় নাফিসাকে।
৪. সুমাইয়া আক্তার
সুমাইয়া আক্তারের বয়স ২০ বছর। আড়াই মাসের একমাত্র বাচ্চাকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে থাকতেন চিটাগাং রোডে। তাদের বাসার পাশে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের সামনের জায়গা ছিল আন্দোলনের স্পট। বাসা থেকেই দেখা যেত সবকিছু। ২০২৪ সালের ২০ জুলাই, শনিবার। বিকেলটা উত্তপ্ত ছিল। মা আছর নামাজ পড়তে যাচ্ছেন। সুমাইয়া তার ছোট বাচ্চাকে মাত্র ঘুম পাড়িয়েছেন। এর মধ্যে আন্দোলনের স্পট থেকে চিৎকার, চেঁচামেচি, গোলাগুলির শব্দ শুনে সুমাইয়া মাকে বলেন, 'সবাই দেহে (দেখে), আমিও যাই একটু দেহি (দেখি)।'
এ কথা বলে বারান্দায় যান বাইরের দৃশ্য দেখতে। এর কিছুক্ষণ পরেই মা একটা চিৎকার শুনতে পান। খুব বেশি জোরে চিৎকার ছিল না বলে জানান মা। 'আওয়াজ হইছেরি (হলে) আমি চারদিকে তাকাইছি। সামনে তাকাই দেহি (দেখি) আমার মেয়ে নিচের দিকে ঢইল্যা (ঢলে) পড়ে যাইতেছে। আমি ভাবছি, আতঙ্কে এমন হইছে নাকি! সামনে গিয়ে জড়ায় ধরছি। দেখি কল চাপলে যেরাম (যেরকম) পানি পরে, ওইরাম (ওইরকম) ব্লাড পড়তেছে। আমি চিৎকার দিয়ে ওঠছি, কে আছো ওরে বাঁচাও। আমার ছেলেরা কান্নাকাটি শুনে দৌঁড়াই আসে। তারা কোনো কূলকিনারা পায় না। চিৎকার, কান্নাকাটি করতে থাকে।'
বারান্দায় গ্রিলের পাইপ ভেদ করে গুলি এসে লেগেছিল সুমাইয়ার মাথায়। মা আর ভাইয়েরা টাওয়াল দিয়ে মাথা বেঁধে রক্তপাত বন্ধ করতে চেষ্টা করেন। কাজ হয় না। মা ছোট ভাইকে পাঠান আশপাশের ফ্ল্যাটের মানুষকে ডেকে আনতে। তারা ছোট ভাইয়ের চিৎকারে ছুটে আসেন। ধরাধরি করে সুমাইয়াকে নিয়ে আসা হয় বাড়ির নিচে। কিন্তু কোনো গাড়ি পাওয়া যায় না হাসপাতালে নিতে। কেউ রাজি হন না আন্দোলনের সামনে দিয়ে মেডিকেল যেতে। শেষে বড় মেয়ে খবর পেয়ে ছুটে আসেন।
'আমার মেয়ে সবার হাতে-পায়ে ধরে। আমার বোনটারে বাঁচাইতে হবে। হাসপাতালে নিতে গাড়ির ব্যবস্থা করেন।'
সুমাইয়ার বড় বোনের কান্নাকাটিতে দুটো অটো রাজি হয় মেডিকেলে যেতে। সুমাইয়াকে নিয়ে যাওয়া হয় প্রো-অ্যাকটিভ হাসপাতালে। সেখানে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সুমাইয়ার মরদেহ গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে নিয়ে যেতে চাইলে পথে বাঁধার সম্মুখীন হয় তার পরিবার। পরে সিদ্ধিরগঞ্জ পুল এলাকায় তাকে দাফন করা হয়।
সুমাইয়ার স্বামী জাহিদ হোসেন কাজ করেন স্থানীয় একটি কারখানায়। সুমাইয়ার মৃত্যুর পর থেকে আড়াই মাসের বাচ্চার খোঁজখবর কিংবা তার মায়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখছেন না বলে আক্ষেপ করেন সুমাইয়ার মা। ছোট বাচ্চাটি বড় হচ্ছে নানীর কাছে। সুমাইয়ার বাবা এলাকার মাতব্বর ছিলেন। অনেক আগে মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর বরিশাল থেকে মা পাঁচ ছেলে-মেয়েকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে এসে বসবাস করছিলেন।
৫. শাহিনূর বেগম
শাহিনূর বেগম। বয়স ৫৭। ২০২৪ সালের ২২ জুলাই ফজর নামাজ পড়ে কাজলা সেতুর দিকে হাঁটতে বের হয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন আরও দুই-তিন জন নারী।
সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কাজলায় গুলিবিদ্ধ হন। প্রায় ঘণ্টাখানেক রাস্তায় পড়ে ছিলেন। সকাল ১০টার দিকে বাসায় মেয়েদের কাছে খবর যায় তার মা গুলিবিদ্ধ। তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল শনির আখড়ার একটা হাসপাতালে। সেখান থেকে বলা হয় ঢাকা মেডিকেলে নিতে। যে ব্যক্তি রাস্তা থেকে তুলে মেডিকেলে নিয়ে আসছিলেন, তিনি ভ্যানগাড়ি করে তাকে নিয়ে যান। ডাক্তার জানান, দ্রুত অপারেশন করতে হবে। কিন্তু তার স্বজন ছাড়া কীভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন। পরে তার সেলোয়ারের খুঁটে মোড়ানো একটা বাটন ফোন পান। সেখান থেকে ডায়াল কলের নম্বরে কল করলে রিসিভ করেন তার মেয়ে। তাকে জানানো হয় তাড়াতাড়ি মেডিকেলে আসতে। মেয়ে খবর পাওয়া মাত্রই ছুটে যান ঢামেকে।
'আমার মায়ের ধারে (কাছে) টাহা (টাকা) ছিল। স্বর্ণ গয়না ছিল। সব নিয়ে গেছে গা। শুধু গায়ে একটা জামা-সেলোয়ার ছিল। মোবাইলটা সেলোয়ারের ভেতর থাকায়, ওইটা থেকে নম্বর নিয়ে আমগেরে জানায়। আমি যাই দেখি, আমার মা পড়ে আছে মেডিকেলে। যে লোকটা মারে নিয়ে গেছে হাসপাতালে ওই লোকরে মনে হয় আল্লা ফেরেশতা হিসেবে পাঠাইছে আমার মার জন্য। না হয় এক ঘণ্টা রাস্তায় পরে ছিল, কেউ হাসপাতালে নেয় নাই। শুনছি, মা পাগুলো দিয়ে ধাবড়াইছে সারাক্ষণ।'
ডাক্তার বলেন, তাকে বাঁচাতে হলে দ্রুত অপারেশন করতে হবে। আইসিইউতে রাখতে হবে। কিন্তু কোনোভাবে মেয়ে আইসিইউর ব্যবস্থা করতে পারছিলেন না। 'বলার মতো না। সে কথা মনে পড়লে বুকটা ফাইট্যা যায়। সবার হাতে-পায়ে ধরতেছি, আমার মার জন্য আইসিইউর ব্যবস্থা করেন। কোনো কাজ হয় নাই। তিনদিন পর আইসিইউ পাইছি। এক মাস নয় দিন মাকে রাখছিলাম ঢাকা মেডিকেল। কিন্তু একটা উত্তর, একটা কথা পাই নাই মায়ের। পা আর হাত লাড়াইছে শুধু।'
কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মেয়ে। কিছুক্ষণ পর থেমে আবারও বলতে শুরু করেন, 'যদি প্রথম দিনি আইসিইউ পাইতাম, তাহলে হয়ত আমার মার একটা জবান পাইতাম। সারাজীবন মা আমাগোরে নিয়ে রোজার ইফতার করছে। এবার ইফতারে মা নাই, আমরা পাঁচ ভাই-বোন একা। বাপ থেকেও নেই!'
পাঁচ ছেলে-মেয়ে নিয়ে শাহিনূর বেগম থাকতেন শনির আখড়ায়। স্বামী প্যারালাইজড হয়ে ঘরবন্দী। মাছের ব্যবসা করে সংসার চালাতেন। তার মৃত্যুর পর পুরো পরিবার এখন নিঃস্ব, মানবেতর জীবনযাপন করছে। একমাসের মধ্যে তাদের শহর ছেড়ে ফিরতে হয়েছে কুমিল্লায়।
৬. মোসাম্মত লিজা
১৮ বছরের মোসাম্মত লিজা। আর্থিক অনটনে বছর ছয়েক আগে বড় ভাই মোহাম্মদ রাকিবের মাধ্যমে ঢাকায় এসেছিলেন কাজ করতে। শান্তিনগরে একটি বাসায় গৃহকর্মীর কাজ নেন লিজা। ওই বাসায় কাজ করতেন, পাশাপাশি পাশের একটা মহিলা মাদরাসায় আরবি পড়তেন।
শান্তিনগরে যে বাসায় কাজ করতেন লিজা সেই ভবনটি ছিল ১৪তলা। তারা থাকতেন সপ্তম তলায়। ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই ছিল বৃহস্পতিবার। বিকেলে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগ গোলাগুলি শুরু করলে বাসা থেকে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজে বারান্দায় দেখতে যান লিজা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া দেখা অবস্থায় একটা গুলি এসে লাগে তার মাথায়। মুহূর্তেই মেঝেতে লুটিয়ে পরেন তিনি।
তার চিৎকারে দৌঁড়ে বারান্দায় আসেন বাসার লোকজন। উদ্ধার করে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় পাশের হাসপাতালে। এর মধ্যে বিকেল সাড়ে ৩টায় খবর পাঠানো হয় তার বড় ভাই রাকিবকে। রাকিব বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের কাজ করেন। ছিলেন গাজীপুরে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে হতভম্ব হয়ে পড়েন ভাই। বাড়িতে কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এর মধ্যে ভাই ঢাকায় আসতে চেষ্টা করলেও প্রতিটি পয়েন্টে বাঁধার সম্মুখীন হন। না আসতে পেরে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে থাকেন মেডিকেলে বোনের সঙ্গে থাকা মানুষদের সঙ্গে। তারা সবাই সান্ত্বনা দেন, পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে।
২০ জুলাই ভেঙে ভেঙে রিকশা ও পায়ে হেঁটে শান্তিনগরে আসেন। ২১ জুলাই উন্নত চিকিৎসার জন্য লিজাকে নিয়ে যাওয়া হয় পপুলার হাসপাতালে। সেদিন রাতে ৮টায় তার অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর একদিন পরে না ফেরার দেশে চলে যান লিজা।
৫ বোন ও ২ ভাইয়ের মধ্যে লিজা চতুর্থ। মারা যাওয়ার আগের দিনগুলোতে ভাইয়ের সঙ্গে কথা হলে তাকে বুঝাতেন ভাই, 'তুই বড় হয়ে গেছস। বাবা-মা তোর জন্য ছেলে দেখতেছে। তুই বাড়িতে চল বোন।'
সর্বশেষ কথোপকথনে লিজা ভাইকে বলেছিল, 'আর তিন মাস, আমি এর মধ্যে হাফেজা হয়ে যাব। তখন একবারে বাড়িতে চলে যাব।'
তিনমাস হয়নি, তার আগেই লিজা একবারেই বাড়িতে চলে গেলেন। তবে জীবিত নয়। লিজাদের বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিন থানার দেউলাশিবপুর গ্রামে। দাফন করা হয়েছে পারিবারিক কবরস্থানে।
৭. নাছিমা আক্তার
২৪ বছর বয়স ছিল নাছিমা আক্তারের। জুলাইয়ে ঢাকায় বেড়াতে এসেছিলেন বড় ভাইয়ের বাসায়—সায়েন্সল্যাব, ধানমন্ডি ১ নম্বর রোডে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সায়েন্সল্যাব মোড় প্রতিদিনই ছিল উত্তপ্ত। ধানমন্ডিতে আন্দোলনের প্রধানকেন্দ্র ছিল এটি। ১৮ জুলাই আন্দোলনে আহত হওয়ায় পরদিন বাসা থেকে বের হয়নি তার ভাতিজারা। ১৯ জুলাই সবাই বাসার ভেতরই ছিল। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় জানালার ফাঁক দিয়ে কিংবা ছাদে গিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখে সময় কাটিয়েছেন তারা।
ওইদিন দুপুরের পর থেকে কিছুক্ষণ পর পর শুনতে পান মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া হেলিকপ্টারের তীব্র আওয়াজ। সেদিন হেলিকপ্টার থেকে টিয়ারগ্যাস, রাবার বুলেট ছোঁড়া হয়েছিল ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে। অসংখ্য মানুষ টিয়ারগ্যাসে আহত হন। বিকেলে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে নাছিমার বড় ভাতিজা মেঝ ভাতিজাকে বলে, 'চল আমরা ছাদে গিয়ে দেখি সায়েন্সল্যাবের দিকের পরিস্থিতি।'
দুই ভাই যান ছাদে। তাদের পেছনে পেছনে ছুটে যান নাছিমাও। ছাদে যাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই গুলিবিদ্ধ হন নাছিমার ভাতিজা, একই গুলি আঘাত করে নাছিমার শরীরেও। নাছিমা ছাদে মুখ থুবড়ে পরেন। গুলিবিদ্ধ ছেলে দৌঁড়ে বাসায় এসে মাকে বলে, 'আম্মু, আমার গায়ে গুলি লাগছে।' এ কথা বলেই সেন্সলেস হয়ে যায়। আরেক ছেলে খবর নিয়ে আসে ছাদে ফুপিও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। গলা দিয়ে গুলি ঢুকে খাদ্যনালীতে গিয়ে আঘাত করেছে গুলি।
একদিকে গুলিতে আহত ছেলে, অন্যদিকে ননদ ছাদে গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে খবর আসছে। দিশেহারা ভাবি রেহানা আক্তার কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না। নিজেদের গাড়ির ড্রাইভারকে কল করলেন। দুজনকে দ্রুত নিয়ে গেলেন পাশের পপুলার হাসপাতালে। ভর্তি করানো হলো আইসিইউতে। ছেলে সুস্থ হয়ে ফিরলেও একদিন পর ননদ চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
মৃত্যুর পরদিন নাছিমার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর মাইজদীতে। পাশেই মনপুরা গ্রামে নানার বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে।
অষ্টম ক্লাস পর্যন্ত মাদরাসায় পড়ালেখা করে আর করা হয়নি। ৪ বোন ৩ ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন নাছিমা।
৮. রিতা আক্তার
রিতা আক্তার। বয়স মাত্র ১৭ বছর। স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হয়ে দরিদ্র বাবা-মায়ের অভাব-অনটন ঘুচাবে। কিন্তু স্বপ্নপূরণের আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো তাকে।
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার পুনট ইউনিয়নের তালখুর গ্রামে রিতাদের বাড়ি। বাবা আশরাফ আলী রিকশাচালক; মা রেহেনা বিবি গৃহিণী। তিন ভাই-বোনের মধ্যে রিতা মেঝ। বড় ভাই খুব বেশি পড়াশোনা করেননি, বর্তমানে দিনমজুর। ছোটভাই মাত্র প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়েছেন। পড়াশোনায় ভালো হওয়ায় রিতাই ছিল পরিবারের একমাত্র আশা-ভরসা। বাবা-মাকে সবমসময় বলত, বড় হয়ে ডাক্তার হবে, পরিবারের হাল ধরবে। মেয়েকে একটু ভালোমতো পড়াশোনার সুযোগ তৈরি করে দিতে সাধ্যের সব চেষ্টা চালাতেন বাবা-মা। মা রেহেনা বিবি বাসাবাড়িতে কাজ করে আয়ের সেই টাকায় মেয়ের পড়ালেখার খরচ চালাতেন।
মেয়ে মাধ্যমিকের পাশ করার পর উচ্চমাধ্যমিকে শহুরে প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করানোর জন্য বাবা সপরিবারে আসেন ঢাকায়। মিরপুর দুয়ারীপাড়া সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করান মেয়েকে। মেয়ের পড়ালেখার সুবিধার জন্য কলেজের পাশেই মিরপুর-২ এইচ ব্লকে কম ভাড়ায় একটা ছোট্ট বাসা ভাড়া নেন। মিরপুর এলাকায় বাবা চালাতেন রিকশা, মা বাসাবাড়িতে কাজ করতেন।
৫ আগস্ট সকালে বাবা বের হয়ে যান রিকশা নিয়ে, মা যান বাসাবাড়িতে কাজে। এ সুযোগে রিতা ১১টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে চলে যান মার্চ-টু-ঢাকা কর্মসূচিতে যোগ দিতে। দুপুরে মা ঘরে ফিরে দেখেন মেয়ে নেই। খুঁজতে বের হন। আশপাশে অনেক খোঁজাখুঁজির পর কোথাও পেলেন না মেয়েকে। সন্ধ্যা পর্যন্ত মেয়ের খোঁজ না পেয়ে মেডিকেল কলেজগুলোর মর্গে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। এক মেডিকেল থেকে আরেক মেডিকেল দৌঁড়াদৌঁড়ি করে রাত ১০টার পর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের মর্গে মেয়ের মরদেহ পান। গায়ের জামাকাপড় দেখে মেয়েকে শনাক্ত করতে পারেন তিনি।
আহত রিতাকে মেডিকেলে নিয়ে আসা ব্যক্তিদের কাছ থেকে পরিবার জানতে পারে, তার মাথার এক পাশ দিয়ে গুলি ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল। তাকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল নিয়ে আসলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা পেতে বিলম্ব হয়। ডাক্তার যখন রিতার চিকিৎসা করতে যান ততক্ষণে আর বেঁচে নেই রিতা। পরদিন মেয়ের মরদেহ নিয়ে বাবা-মা চলে যান গ্রামের বাড়ি। গ্রামের কবরস্থানে রিতাকে দাফন করা হয়।
ছোটবেলা থেকে পড়ালেখার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিল রিতা। ভালো কুরআন তেলাওয়াত ও গান গাইতে পারত। মাধ্যমিকে পড়ালেখা করা অবস্থায় বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় একাধিক বিভাগে পুরস্কার পেয়েছিল।
৯. মায়া ইসলাম
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই। দিনটি ছিল শুক্রবার। দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর সাত বছরের ছোট্ট মুসা বাবার কাছে আবদার করে আইসক্রিম খেতে। বাবা বলেন, 'আমিতো এখন বের হবো। তুমি আমার সঙ্গে চলো। আইসক্রিম কিনে চলে এসো।'
রামপুরা বনশ্রী এলাকায় একটা বাসায় ভাড়া থাকেন তারা। আইসক্রিম নিতে বাসার নিচে বাবার হাত ধরে নামেন ছোট্ট মুসা। পেছনে পেছনে দাদি মায়া ইসলামও নিচে নামেন, নাতিকে আবার বাসায় নিয়ে আসতে। এরমধ্যে ফেরার সময় গেটের সামনে দাঁড়ালে লক্ষ্য করেন, সামনের রাস্তায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ চলছে ছাত্র-জনতার। গোলাগুলিতে গেট আটকিয়ে তাড়াতাড়ি ওপরে উঠতে যাবেন, ওই মুহূর্তে গুলি আঘাত করে নাতির মাথায়। একই গুলি নাতির মাথার তালু ভেদ করে দাদির তলপেটে আঘাত করে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দুইতলার দিকে উঠতে চেষ্টা করলে সিঁড়িতে সেন্সলেস হয়ে পড়েন মায়া। আশপাশের মানুষজন ধরাধরি করে দাদি-নাতিকে নিয়ে যান বনশ্রীর একটি হাসপাতালে। মায়া ইসলামের স্বামী মাহবুব ইসলামের বর্ণনায়, 'আমরা প্রথমে জানতে পারি নাই উনার (মায়া ইসলাম) গায়ে যে গুলি লাগছে। জানতাম নাতির গায়ে গুলি লাগছে। হয়তো নাতিকে হসপিটাল নিয়ে গেছে। ৫-৬ ঘণ্টা পর খবর পেয়ে আমরা মেডিকেলে ছুটে গিয়ে দেখি এ অবস্থা। ডাক্তার চিকিৎসা করাইছে। বলল, সুস্থ হয়ে যাবে, আপনারা বাড়িতে নিয়ে যান। এর পরদিনই অবস্থা খারাপ হতে থাকলে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যাই। সেখানেই মারা যান।'
নাতি তখনো হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে, অন্যদিকে দাদির লাশ নিয়ে আত্মীয়স্বজন পরদিন ফিরতে হয়েছে গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। সেখানে পারিবারিক কবরস্থান দাফন করা হয় তাকে। কয়দিন আগে ডাক্তার জানান, নাতিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠাতে হবে। পরে দেশে-বিদেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান শিশুটির চিকিৎসার জন্য অর্থ সাহায্যের ব্যাপারে এগিয়ে আসেন। তাদের সহযোগিতায় শিশুটিকে নিয়ে যাওয়া হয় সিঙ্গাপুর। গত ৪ মার্চ শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে চিকিৎসারত আছে নাতি মুসা।
মায়া ইসলামের বয়স হয়েছিল প্রায় ৬০ বছর। মায়া-মাহবুব দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান মালিবাগ বাজারে ইলেকট্রনিক্সের একটি দোকান চালান। বাবাও সেই দোকানে সময় দেন। ইলেকট্রনিক্সের দোকান থেকে আয়কৃত টাকায় চলে তাদের পরিবার।
১০. মেহেরুন নেছা তানহা
মেহেরুন নেছা তানহার বয়স ছিল ২২ বছর। পড়াশোনা করছিলেন মিরপুরের হযরত শাহ আলী মহিলা কলেজে, অনার্স তৃতীয় বর্ষে। বাবা মোশাররফ হোসেন গাড়িচালক, মা আছমা আক্তার গৃহিণী। পড়ালেখার পাশাপাশি পার্টটাইম কাজ করতেন মেহেরুন নেছা। নিজের খরচ নিজেই বহন করতেন। মেহেরুনদের বাসা মিরপুরে।
শুরুর দিকে মেহেরুন রাজপথে আন্দোলনে তেমন সম্পৃক্ত ছিলেন না। ১৯ জুলাই জুমার নামাজ পড়ে মিরপুর মাজার রোডে আন্দোলনে যোগ দেয় মেহেরুনের মামাতো ভাই রাব্বি। সেই মিছিলে পুলিশের গুলিতে মারা যায় রাব্বি। পুলিশ নির্মমভাবে হত্যা করে রাব্বিকে। তার মরদেহ মেডিকেল মর্গে আটকে রেখেও ঝামেলা করে পরিবারের সঙ্গে। তিনদিন পর মরদেহ দেওয়া হয়। এ ঘটনার ক্ষোভ থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন মেহেরুন ও তার ছোট ভাই তারিফ। মামাতো ভাই হত্যার বিচার চেয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে আন্দোলনে যোগ দেন মেহেরুন। তার হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে লেখা থাকতো, 'আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না'।
মেহেরুনের বাবা বলেন, 'কোনোভাবে তাদের ঘরে ধরে রাখতে পারতাম না। ওরা বলতো, আমাদের ভাই শহীদ হয়েছে, আমরা ঘরে বসে থাকতে পারি না। আমাদের ভাই হত্যার বিচার চাইতে রাস্তায় নামতেই হবে। এ বলে প্রতিদিনই বের হতো।'
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালালে সারাদেশে উৎসুক জনতা আনন্দ মিছিল করে। মেহেরুন ও তার ছোট ভাইও বের হন আনন্দ মিছিলে যোগ দিতে। গণভবন ও সংসদ ভবন এলাকায় আনন্দ উদযাপন শেষে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় মেহেরুন বাসার দিকে ফিরেন। ভাই তখনো বাইরে থেকে যান। মেহেরুন বাসায় ফেরার পথে মিরপুর-১৩ এর নতুন বাজারের দিকে পুলিশের মুখোমুখি হন। তখনো ওইদিকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ চলছিল ছাত্র-জনতার। সংঘর্ষের মধ্যে মেহেরুন নিরাপদে বাসায় ঢুকেন। বাসায় ফিরে নিজের রুমে ঢুকে ছোট ভাইকে কল করে জানায়, নতুনবাজারের দিকে সংঘর্ষ হচ্ছে, সে যেন অন্য রাস্তা দিয়ে বাসায় ফেরে। এর মধ্যে জানালার সামনে দাঁড়াতেই একটা গুলি এসে লাগে তার শরীরে। মুহূর্তে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন মেহেরুন। তাড়াতাড়ি নিকটস্থ মেডিকেলে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওইরাতে ১১টার দিকে জানাজা শেষে মিরপুরের পূর্ববাইশটেক কবরস্থানে দাফন করা হয় মেহেরুনকে। তাদের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের হরিরামপুর।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: