‘জোর’ করে ঐকমত্যের চেষ্টা, রাজনীতিবিদদের প্রতিক্রিয়া

ঐকমত্য কমিশনের ধারাবাহিক অনেকগুলো বৈঠকের পরও সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় সংস্কার প্রক্রিয়ায় এখনও কাঙ্খিত ফলাফল আসেনি। ‘জুলাই সনদ’ এখনও প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। যদিও রোববার (২৭ জুলাই) ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে জুলাই সনদের একটি খসড়া প্রস্তুত করেছে ঐকমত্য কমিশন।
সোমবারের (২৮ জুলাই) মধ্যে এই খসড়া দলগুলোকে পাঠানো হবে। তবে অন্যান্য আরও কয়েকটি বিষয়ে এখনও একমত হতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। মতৈক্য সৃষ্টি না হওয়ায় সংস্কার নিয়ে রয়েছে নানা সংশয়।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের একের পর এক সংলাপ ও বৈঠকে নানা বিষয়ের ওপর আলোচনা হলেও মূল সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বেশিরভাগেই এখনও রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। ব্যর্থতার দায় রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছে। ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বড় ইস্যুগুলোর মধ্যে জরুরি অবস্থা ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগেই দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়। একইভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফেরার বিষয়ে দলগুলো একমত জানালেও এর কাঠামো ও পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্য আসেনি। বিশেষ করে এ সরকারে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে আলাদা আলাদা প্রস্তাব দিয়েছে।
জুলাই সনদকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথচলায় একটি ঐতিহাসিক দলিল তৈরি করতে চায় বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ। সোমবার (২৮ জুলাই) ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের ২০তম দিনে বৈঠকের শুরুতে এ সব কথা বলেন তিনি।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, মৌলিক সংস্কারের ২০টি বিষয়ের মধ্যে ১২টি বিষয়ে একমত হয়েছে দলগুলো। কমিশনের পক্ষ থেকে প্রাথমিক প্রস্তাবনাগুলো বারবার পরিবর্তন করা হয়, যেন রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারে। আজকে নারী আসনে নির্বাচন পদ্ধতি ও অমিমাংসীত বিষয়ে আলোচনা করবে কমিশন।
এর আগে নির্বাচন কমিশন নিয়োগের আলোচনায় একমত হয়েছিল বিএনপি, তবে সংবিধিবদ্ধ ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য নিয়োগে বিরোধিতা করেছে দলটি।
সোমবার (২৮ জুলাই) জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক থেকে ওয়াকআউট করে বিএনপি। সরকারি কমিশন, দুদক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগ ইস্যুতে আলোচনা থেকে ওয়াকআউট করে দলটি। ওয়াকআউটের কারণ জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা কিছু সময়ের জন্য ওয়াকআউট করলাম। কারণ, আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার ছিল যে- সাংবিধানিক কিছু প্রতিষ্ঠান এবং সংবিধিবদ্ধ দুই-একটি প্রতিষ্ঠানে যে নিয়োগ, এটা নিয়ে কমিটি করা এবং সেটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা, এটায় ভবিষ্যতে সরকার বা রাষ্ট্র পরিচালনায় জটিলতার সৃষ্টি হবে।
এর আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ প্রশ্ন তুলেছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সব প্রস্তাবে একমত হতে বললে আলোচনার জন্য ডাকা হলো কেন? তিনি বলেন, কমিশনে আমাদের একটা শর্ত ছিল যে, এনসিসির মতো বা সাংবিধানিক নিয়োগ কমিটির মতো কোনো বিষয় এখানে থাকলে সেই বিবেচনাটা আগের প্রস্তাব অনুসারে যেতে হবে আমাদের। সেই বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে এমপিরা ভোট দেয়ার বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। ঐকমত্য তো পোষণ হচ্ছেই। এখন যদি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সব প্রস্তাবে আমাদের শতভাগ একমত হতে বলে তাহলে আলোচনার জন্য ডাকা হলো কেন?
তিনি আরও বলেন, জাতীয় ঐকমত্য পোষণ হলে যেসব বিষয়ে দলসমূহ একমত হবে, সেই বিষয়গুলো এক করে জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদে সই হওয়ার কথা। এখন যদি আমাদের বাধ্য করা হয় যে এসব বিষয়ে একমত হতেই হবে, সেটাতো সঠিক হলো না।
জুলাই সনদের বিষয়ে সোমবার (২৮ জুলাই) জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন-
আগামী নির্বাচনে আনুপাতিক পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্যে না আসলে জুলাই সনদে স্বাক্ষর হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে উচ্চকক্ষ, আমরা বলেছিলাম উচ্চকক্ষটি ভোটার অনুপাতে হতে হবে, পিআর অনুসারে হতে হবে। এই উচ্চকক্ষ আমাদের ক্ষমতার ভারসাম্য ও জবাবদিহির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেই বিষয়ে এখনও ঐকমত্য আসেনি। এ বিষয়ে সবার মধ্যে ঐকমত্য না আসলে, জুলাই সনদে স্বাক্ষর হবে কিনা আমাদের সন্দেহ আছে। এ বিষয়ে ঐকমত্যে আসার পরই আমরা জুলাই সনদের বিষয়টি বিবেচনা করব।’
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক ও সংস্কার নিয়ে চ্যানেল 24 এর মুক্তবাক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছিলাম, আপনি যখন দায়িত্ব নিয়েছেন এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে মানুষের কাছে সরকার সম্পর্কে ভুল বার্তা যায়। আরেকটা বলেছিলাম, এবার গণঅভ্যুত্থানে কোনও গোষ্ঠী বা দল জয়ী হয়নি। অনেক জায়গায় রিপ্লেমেন্ট করতে হবে। দ্রুততার সঙ্গে একটি নীতিমালা তৈরি করেন। দক্ষ আর নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের যাতে নিয়োগ দেয় যায়, ওইভাবে কাজ করেন। এ আলোচনার পর একজন উপদেষ্টা কথা টেনে নিয়ে বললেন, আপনারা কি বলতে পারেন- এ সরকারের ৩০ দিন, ৬০ দিনে করণীয় কী? আমরা বললাম, আমাদেরকে ডাকলে অবশ্যই করণীয় নিয়ে বলব। তখন তারা বলল, সেপ্টেম্বরে (২০২৪) আপনাদের সঙ্গে বসবো। গত বছর এ কথা হয়েছে। আজ পর্যন্ত সেপ্টেম্বরের দেখা মিলল না।
রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি আপনাকে দল নিরপেক্ষ থাকা উচিৎ। আপনি যদি সুশাসন না দিতে পারেন, তাহলে মানুষ ভাববে আগেরটাই ভালো ছিলো। এটি ক্ষতিকর হবে। জুলাই গণহত্যার বিচার দৃশ্যমান হচ্ছে। সংস্কার বিষয়ে মোটেই কম আলোচনা হয়নি। সব এক কাঠামোর মধ্যে আপনি আনতে পারবেন না, এটি অসম্ভব। আমরা ক্ষমতায় গেলে একধরনের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি করবো, অন্য আরেকদল ক্ষমতায় গেলে আরেক রকম করবে। আরেকজন ক্ষমতায় গেলে আরেকটা নীতিমালা করবে। আদর্শের মিল তো হবে না। আমরা এখন যেটা করতে পারি, তা হলো- যেটা গণতন্ত্রের চলার পথে ঐকমত্য হয়। এ পর্যন্ত যতটুকু হয়েছে, আমার বিবেচনায় একেবারেই কম হয়নি। আমরা বারবার বলছি, জোর করে ঐকমত্যের চেষ্টা যথাযথ হবে না।
LIMON
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: