ভেঙে পড়েছে উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসকসেবা
তিন বছর ধরে বিভাগীয় একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত তানভীর ইসলাম (ছদ্মনাম)। গত বছরের ডিসেম্বরে দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করা হয় তাকে। কিন্তু কর্মস্থলে যোগদান করেই তিন দিনের মাথায় আরেক মেডিকেল কলেজে বদলির জন্য আবেদন করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। ব্যবহার করেন রাজনৈতিক দলের নেতার সুপারিশ, সফলও হন তিনি।
জানতে চাইলে ওই চিকিৎসক বলেন, ‘উপজেলায় কাজের পরিবেশের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। রোগীর চাপ তো রয়েছেই, সঙ্গে কর্মস্থলে নিরাপত্তাহীনতা একটা বড় কারণ। পাশাপাশি বছরের পর বছর এখানে থাকলেও পদোন্নতি মেলে না। তাহলে কেন থাকব সেখানে?’
গ্রামে থাকতে না চাওয়ার এই মনোভাব শুধু ডা. তানভীরের নয়, সরকারি চিকিৎসকদের অধিকাংশের। এমনিতেই চিকিৎসক সংকট, তার ওপর বড় অংশ রয়েছেন শিক্ষা ছুটিতে। কেউ আবার সংযুক্তি নিয়ে চলে গেছেন ঢাকাসহ সুবিধামতো শহরের হাসপাতালে। এতে ভেঙে পড়েছে উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসাসেবা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানসম্মত চিকিৎসা দিতে হলে সবার আগে উপজেলায় বাড়াতে হচ্ছে চিকিৎসকের পদ। প্রতিবছর পাঁচ হাজারের বেশি চিকিৎসক উচ্চশিক্ষার জন্য ছুটিতে থাকেন, যার খেসারত দিতে হয় কর্মস্থলে থাকা চিকিৎসক ও রোগীদের। পাশাপাশি নিরাপদ কর্মস্থলের অভাব, বছরের পর বছর পদোন্নতিবঞ্চিত ও পারিপার্শ্বিক চাপের কারণে চিকিৎসকরা গ্রামে থাকতে চান না।
অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘অবকাঠামোগত সমস্যা, সামাজিক মর্যাদার অভাব, কর্মস্থলে নিরাপত্তাহীনতা, বৈষম্য ও পদায়নজনিত অনিয়মের কারণে চিকিৎসকরা গ্রামে থাকতে চান না। এসব কারণেই মূলত তাদের মাঝে শহরমুখো প্রবণতা দিন দিন বেড়েছে। তারচেয়েও বড় সমস্যা পাঁচ হাজার চিকিৎসক প্রতিবছর উচ্চশিক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি থাকেন। এসব পদ সৃষ্টি করা গেলে সমস্যা থাকবে না।’
সাড়ে ৭ হাজার চিকিৎসকের ৫৩ শতাংশ পদই ফাঁকা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের ৪৯২টি উপজেলা হাসপাতালে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার চিকিৎসকের পদ রয়েছে। এর মধ্যে চার হাজার পদই খালি। শতকরায় যা প্রায় ৫৩ শতাংশ। পদে না থাকা চিকিৎসকদের একটি অংশ উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকাসহ অন্যত্র যুক্ত থাকেন। পাশাপাশি আরেক দল রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে শহরে বদলি নেন।
বদলির পরও কর্মস্থলে যাননি ৫ শতাধিক চিকিৎসক
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ২০ মার্চ পর্যন্ত প্রায় আট মাসে ৬ হাজার ৫৫৬ জনকে বদলি করা হয়েছে। এর মধ্যে বড় একটি অংশ কর্মস্থলে যোগদান করলেও পাঁচ শতাধিক চিকিৎসক যোগদান করেননি। তাদের বেশিরভাগের পদায়ন উপজেলা হাসপাতালে। তারা যোগদান না করেও শহরে আসতে নানাভাবে অধিদপ্তরে তদবির করছেন।
গত ১৮ থেকে ২০ মার্চ সরেজমিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দেখা যায়, প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চিকিৎসকরা বদলির জন্য ভিড় করছেন। অনেকে নিজে থেকে দাবি নিয়ে আসছেন, কেউ বিএনপি ও জামায়াতপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠনের নেতাদের সুপারিশ নিয়ে হাজির হয়েছেন। আছেন জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের সুপারিশ নিয়ে আসা চিকিৎসকও। চিকিৎসকদের এমন শহরমুখো মানসিকতায় চরম হুমকির মুখে পড়েছে স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা।
এদিকে উপজেলা হাসপাতালে এসে রোগীরা ভিড় করলেও পাচ্ছেন না চিকিৎসাসেবা। চিকিৎসকের অভাবে অনেক হাসপাতালে বন্ধ রয়েছে অস্ত্রোপচার ও রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। মিলছে না প্রয়োজনীয় ওষুধও।
নওগাঁর ৫০ শয্যার সাপাহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপজেলার প্রায় দুই লাখ মানুষ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী পত্নীতলা, পোরশা ও ধামইরহাট উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের বাসিন্দা চিকিৎসা নেন। প্রতিদিন গড়ে চিকিৎসা নিতে আসেন ৬০০-৭০০ রোগী। এই বিপুলসংখ্যক রোগীর চিকিৎসায় কাজ করছেন মাত্র তিনজন মেডিকেল অফিসার। অথচ প্রতিষ্ঠানটিতে কনসালট্যান্টসহ চিকিৎসকের পদ রয়েছে ২৮টি।
দিনাজপুরের ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাকিমপুর উপজেলা হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার ও কনসালট্যান্ট মিলে চিকিৎসকের পদ ২৪টি। হাসপাতালটির বহির্বিভাগে প্রতিদিন ৩০০-৪০০ রোগী চিকিৎসা নেন। এ ছাড়া জরুরি বিভাগ ও ভর্তি রোগীদের চাপ তো আছেই। এসব বিভাগ চলছে মাত্র দুজন মেডিকেল অফিসার দিয়ে।
হাসপাতালটিতে সার্জনের অভাবে বন্ধ রয়েছে অস্ত্রোপচার। ৯৫ ধরনের ওষুধের তালিকা থাকলেও পাওয়া যাচ্ছে ৩৫ ধরনের। ফলে অধিকাংশ ওষুধ রোগীদের কিনতে হচ্ছে বাইরে থেকে।
হাকিমপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. ইলতুতমিশ আকন্দ বলেন, ‘জরুরি বিভাগ ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে চাইলেও অন্তত চারজন ডাক্তার লাগে। সেখানে পুরো হাসপাতালেই আছেন দুজন। এত চাপ নিয়ে কীভাবে চিকিৎসকরা কাজ করবেন। এ জন্য সবাই চান কত দ্রুত উপজেলা থেকে চলে যেতে পারেন।’
ইলতুতমিশ আকন্দ বলেন, ‘উপজেলা পর্যায়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা কাজের পরিবেশ না থাকা। কর্মস্থলে নিরাপত্তাহীনতার কারণে বড় কোনো অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে দশবার ভাবতে হয়। প্রভাবশালী মহল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও একটু এদিক-ওদিক হলেই শক্তি দেখানোর চেষ্টা করেন। এ ছাড়া আমি কতদিন উপজেলায় থাকব, সেটি নিশ্চিত নয়। প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা জানেন তিনি চার-পাঁচ বছর এসি ল্যান্ড থাকার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কিংবা অন্য কোনো জায়গায় পদোন্নতি পাবেন। কিন্তু চিকিৎসকদের সেরকম পদোন্নতির সুযোগ নেই। ফলে ১০ বছর ধরে মেডিকেল অফিসার থাকলেও কোনো উন্নতি হয় না।’
শুধু সাপাহার কিংবা হাকিমপুর উপজেলাতেই নয়, বরং প্রতিনিধিদের পাঠানো সারা দেশের অন্তত ৩০টি জেলার শতাধিক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এমন দুর্দশা ফুটে উঠেছে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. এবিএম আবু হানিফ বলেন, ‘ভৌগোলিক কারণে কোথাও চিকিৎসক কম, কোথাও বেশি। উপজেলায় বড় ঘাটতির কারণ চিকিৎসকদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ। কিন্তু এটিরও প্রয়োজন আছে। আমাদের শিক্ষা ছুটিতে যারা আছেন, তারা কোর্স শেষ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আসছেন, সেখান থেকে উপজেলাসহ বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। নতুন করে দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। একইসঙ্গে ৫ হাজারের বেশি চিকিৎসকের পদ সৃষ্টির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’
আবু হানিফ বলেন, ‘চিকিৎসকদের শহরমুখী মানসিকতার অনেক বাস্তবতা রয়েছে। যেগুলো যৌক্তিক, সেগুলো দেওয়া হচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় সংযুক্তি বাতিলের বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারপরও যারা কর্মস্থলে যোগদান করেননি, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, ‘কিছুদিন ধরে উপজেলা পর্যায়ে সংকটটা একটু বেশি হচ্ছে। সমস্যা হলো চিকিৎসকরা উচ্চশিক্ষার জন্য অন্যত্র গেলেই এই ঘাটতি দেখা দেয়। আমরা অনেক চেষ্টা করেও এ সংকট কাটাতে পারিনি। এ জন্য দরকার চিকিৎসকদের পদ বাড়ানো।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘প্রতি বছর সব সময় ৫ হাজার চিকিৎসক বিভিন্ন কোর্সে ভর্তি থাকেন, যারা উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত। শতভাগ লোক নিয়োগ দিলেও এসব পদ খালি থাকবেই। এই সংকট কাটাতে পারে সমানসংখ্যক পদ সৃষ্টি করে। সেই প্রক্রিয়া চলমান।’
সায়েদুর রহমান আরো বলেন, ‘উপজেলা পর্যায়ে সব রোগীকে শয্যা দেওয়া সম্ভব হয় না। এ জন্য হাসপাতালের আকার বাড়ানো এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে রোগী আটকাতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে ৬০০ রোগীর অর্ধেককে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক নেই। পাঁচ হাজার চিকিৎসক নিয়োগের মাধ্যমে সেখানে যদি একজন করেও দেওয়া যায়, তাহলে হাসপাতালে রোগীর চাপ কমে আসবে।’
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: