ফেনীর নুসরাত হত্যা মামলার ৬ বছর, এখনও পুলিশি পাহারায় পরিবার

ফেনীর বহুল আলোচিত মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে (১৮) পুড়িয়ে হত্যার ৬ বছর আজ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসামির স্বজনদের হুমকির কারণে এখনও পুলিশি পাহারায় তার পরিবার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ তাকে নিজের অফিসে ডেকে নিয়ে যৌন নির্যাতন করার অভিযোগ ওঠে জেলার সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার উচ্চ তৎকালীন অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে। পরে বিষয়টি পুলিশকে জানায় নুসরাত নিজেই। এরপর ৬ এপ্রিল রাফির মা বাদী হয়ে সেই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করলে পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করলে আদালত তার জামিন আবেদন বাতিল করে কারাগারে পাঠায়।
সেই থেকে নুসরাত ও তার পরিবারকে মামলা প্রত্যাহার করার চাপ দিতে থাকে অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ স্থানীয় প্রভাবশালীরা। যার ধারাবাহিকতায় সে পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় গেলে তাকে মিথ্যা কথা বলে একটি ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে সেখানে বোরকা পরা ৫ ব্যক্তি প্রথমে মামলা তোলার জন্য একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে বলে।
পরে নুসরাত তাতে অস্বীকৃতি জানালে ওই ৫ হত্যাকারী প্রথমে রাফিকে হাত-পা বেঁধে মুখ চেপে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। এরমধ্যে ৩জন পুরুষ এবং ২ জন নারী ছিলেন।
সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে অবস্থার অবনতি দেখে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্ররণ করা হয়। ওইসময় সেখানকার চিকিৎসকেরা জানান, অগ্নিদগ্ধ নুসরাতের শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে গেছে। পরবর্তীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই বছরের ১০ এপ্রিল রাতে মারা যায় সে।
এ ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান (নোমান) বাদী হয়ে ওইসময় সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন।
আলোচিত এই ঘটনা সারা দেশে তোলপাড় হলে ওই বছরের ২৮ মে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত শেষে মাদ্রাসার অধ্যক্ষসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে ৮৬৯ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করে।
৮৭ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর আদালত রায় ঘোষণা করেন। ১৬ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে উল্লেখ করে প্রত্যেককে মৃত্যুদণ্ড দেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক (তৎকালীন) মামুনুর রশিদ। পাশাপাশি প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
এর পাঁচ বছর পর ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বিচারপতি হাবিবুল গনি ও বিচারপতি জাহেদ মনসুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে ডেথ রেফারেন্সে শুনানি শুরু হয়।
বাদীপক্ষের ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম শাহজাহান সাজু বলেন, বিচারপতিদ্বয়ের গঠিত বেঞ্চে গত পাঁচ মাসে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ১৬ আসামের মধ্যে ৭ আসামির শুনানি শেষ হয়েছে। অপর ৯ আসামির শুনানি শেষ হলে হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ এ মামলার রায় প্রদান করতে পারেন। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ঈদুল আজহার পর এ মামলার চূড়ান্ত রায় হতে পারে। উচ্চ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের মামলা লড়ছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল বাসেত ও আসামিপক্ষে মামলা লড়ছেন ব্যারিস্টার মুশফিকুর রহমান।
এ হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্রাপ্তরা হলেন, সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার তৎকালীন অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদদৌলা, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি ও মাদ্রাসার সাবেক সহসভাপতি রুহুল আমিন, সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম, মাদ্রাসার ছাত্র নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন, হাফেজ আবদুল কাদের, আবছার উদ্দিন, আবদুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন, ইমরান হোসেন, মহিউদ্দিন শাকিল, মোহাম্মদ শামীম, কামরুন নাহার ও উম্মে সুলতানা পপি।
ফেনী জেলা কারাগারের জেলসুপার মো. আবদুল জলিল জানান, নুসরাত হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ১৬ আসামির মধ্যে ২ আসামি ফেনী জেলা কারাগারে রয়েছেন। তাদের মধ্যে তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতা রুহুল আমিন ও মাকসুদ আলমের বিরুদ্ধে একাধিক মামলার হাজিরা থাকায় তাদের ফেনী জেলা কারাগারে রাখা হয়েছে। অপর ১৪ আসামির মধ্যে অনেকে কুমিল্লা জেলা কারাগার, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারসহ বিভিন্ন কারাগারে রয়েছেন।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসামির স্বজনদের হুমকির কারণে অনেকটা নিরাপত্তাহীন নুসরাতের পরিবারকে বিগত ৬ বছর ধরেই পুলিশি পাহারায় নিজ বাড়িতে বসবাস করতে হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, মৃত্যুর আগে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুসরাতের দেওয়া জবানবন্দিতে অধ্যক্ষ সিরাজকে এ ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়েছে। এছাড়া মৃত্যু দণ্ডপ্রাপ্ত শাহাদাত হোসেন, নুর উদ্দিনসহ বিভিন্ন আসামির আদালতে দেওয়া জবানবন্দি ও মামলার রায়ে এর পেছনের কারণ উঠে আসে।
আদালতে আসামিদের দেয়া জবানবন্দি থেকে জানা যায়, নুসরাত খুনিদের লক্ষ্য হন ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ আনার পর থেকেই। ওই ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিন আক্তার সোনাগাজী থানায় মামলা করেছিলেন। এরপর থেকেই মামলা তুলে নেওয়ার জন্য নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল পরিবারটিকে। তবে প্রতিবাদে অনড় ছিলেন নুসরাত। আগুন ধরিয়ে দেওয়ার আগমুহূর্তেও তাকে মামলা তুলে নিতে চাপ দেওয়া হয়, কিন্তু নুসরাত তা মানেননি। পরবর্তী সময়ে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায়ও তিনি প্রতিবাদ করে গেছেন।
নুসরাত হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার শাহাদাত হোসেন ও নুর উদ্দিন ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম জাকির হোসাইনের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন। ১১ ঘণ্টা ধরে ৫৭ পৃষ্ঠার জবানবন্দিতে তাঁরা ওই দিনের ঘটনার আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন।
এই দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে জড়িত তদন্ত কর্মকর্তারা বলেন, গ্রেপ্তার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার সঙ্গে দেখা করতে ৩ এপ্রিল যাঁরা কারাগারে গিয়েছিলেন, অধ্যক্ষ তাঁদের সবার কাছে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন।
এরপর তিনি আলাদাভাবে মাদ্রাসাছাত্র ও ‘সিরাজ উদদৌলা সাহেবের মুক্তি পরিষদ’ নামে গঠিত কমিটির আহ্বায়ক নুর উদ্দিন (২০), যুগ্ম আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম (২০) এবং আরেক ছাত্রের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেন।
তিনি তাদের মামলা তুলে নেওয়ার জন্য নুসরাতকে চাপ দিতে বলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি শাহাদাতের সঙ্গে একা কথা বলেন। তখন তিনি চাপে কাজ না হলে প্রয়োজনে নুসরাতকে হত্যার নির্দেশ দেন। আর সে পরিকল্পনা অনুযায়ী পরবর্তীতে নুসরাতকে হত্যা করা হয়।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: