ঢাকায় চালু হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থা
আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২৫ ১১:০৭ এএম

রাজধানীর সড়কে ট্রাফিক বিশৃঙ্খলা কমিয়ে আনতে চালু করা হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম। এই সিস্টেম চালু হলে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, ধুলোবালির মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের। সবুজ, হলুদ ও লাল বাতি দেখে সিগন্যাল পার হওয়া এবং সিগন্যালে দাঁড়াবে সব ধরনের যানবাহন। সিগন্যাল পয়েন্টে থাকছে শক্তিশালী মনিটরিং ক্যামেরা।
শুধু যানবাহন নিয়ন্ত্রণই নয়, পথচারী পারাপারের জন্য ২-৩ মিনিট পরপর নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হবে। এই সময় নির্দিষ্ট সিগন্যাল পয়েন্টের সব সড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। নাগরিকদের রাস্তা পার হওয়া শেষ হলে আবারও যানবাহন চলাচল শুরু হবে। জনসাধারণের রাস্তা পারাপারের সময় সিগন্যাল পয়েন্টে মনোরম মিউজিক বাজতে থাকবে।
পাইলটিং প্রকল্পের আওতায় এই কার্যক্রম আপাতত রাজধানীর চারটি সিগন্যাল পয়েন্টে (শাহবাগ ইন্টারকন্টিনেন্টাল তিন রাস্তা মোড়, বাংলামোটর চৌরাস্তা ট্রাফিক মোড়, সোনারগাঁও চৌরাস্তা মোড়, ফার্মগেট মোড়ে) চালু হচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে এই চার পয়েন্টে চালু করা হবে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ও পথচারী পারাপার কার্যক্রম।
ক্রমান্বয়ে হাইকোর্টের দক্ষিণ পাশের গেট চৌরাস্তা মোড় থেকে শুরু করে মৎস্য ভবন হয়ে কাকরাইল মসজিদ পয়েন্ট, শাহবাগ ইন্টারকন্টিনেন্টাল তিন রাস্তা মোড়, সোনারগাঁও চৌরাস্তা মোড়, ফার্মগেট, জাহাঙ্গীর গেট, মহাখালী রেলক্রসিং পয়েন্ট দিয়ে উত্তরা আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। সর্বসাকুল্যে ২২টি সিগন্যাল পয়েন্টে চালু করা হবে এই কার্যক্রম। পাইলটিং প্রকল্পের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ক্রমান্বয়ে কার্যক্রম সারা ঢাকা শহরে বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কারিগরি সহায়তায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ) অবকাঠামো তৈরি করে দিচ্ছে। চারটি সিগন্যাল পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি সিগন্যাল পয়েন্টের ট্রাফিক পুলিশ বক্সে বসানো হয়েছে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি কন্ট্রোল বক্স। সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে লাইভ মনিটরিং করার জন্য পুলিশ বক্সে রয়েছেন বুয়েটের এক্সপার্ট। আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু হলে তিন শিফটে তিনজন অপারেটর দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা সড়কের কার্যক্রম মনিটরিং করবেন ডিসপ্লে মনিটরিং বোর্ডে। মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করবে ডিএমপির ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা। টেকনিক্যাল সাপোর্ট দেবে বুয়েটের এক্সপার্টরা।
গত সেপ্টেম্বর মাসে বুয়েটের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামানের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞরা প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে কয়েকটি প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। সেসময় প্রধান উপদেষ্টা ওই বিশেষজ্ঞদের দেশীয় প্রযুক্তি এবং স্থানীয় মেশিনারিজ ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনার যন্ত্রপাতি তৈরি করার পরামর্শ দেন। প্রধান উপদেষ্টার উৎসাহে স্থানীয় যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সিগন্যাল বাতি এবং কন্ট্রোল বক্স তৈরি করেন বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিটি সিগন্যাল পয়েন্টে লাল, সবুজ এবং হলুদ বাতি বসানো হয়েছে। দেশীয় প্রযুক্তি হওয়ায় খরচও অনেক কম। বিদেশ থেকে সমমানের মেশিনারিজ আনা হলে অন্তত ১৮-২০ গুণ বেশি খরচ বেশি হতো বলে জানান প্রফেসর হাদিউজ্জামান। মেশিনারিজের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সমস্যা তৈরি হলে খুব দ্রুত সমাধান করা সম্ভব বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, একদিকে যন্ত্রপাতি সহজলভ্য, খরচ কম অন্যদিকে কম সময়ের মধ্যে সমস্যার সমাধান করা যাবে। বাংলাদেশে এখনো পরিপূর্ণভাবে অটোমেটেড সিস্টেমে হয়তো ফলাফল পুরোপুরি পাওয়া যাবে না। তবে শুরু তো করতে হবে। ধীরে ধীরে মানুষ সচেতন হবে, আইন মানতে অভ্যস্ত হবে। তিনি আরো বলেন, ‘এই সিস্টেমে জরুরি প্রয়োজনে ম্যানুয়ালিও অপারেট করা যাবে। তাই এটাকে পরিপূর্ণ স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম না বলে সেমি-অটোমেটেড কন্ট্রোল সিস্টেম বলা যায়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. সারওয়ার বলেন, অনেক সময় নানা কারণে রাস্তাঘাট বন্ধ থাকে। দীর্ঘ সময় পর ওই সড়কে যানবাহন চলাচল শুরু হলে তখন সেটি বেশিক্ষণ চালু রাখতে হয়। অটোমেটিক সিস্টেমে চললে তখন ওই সড়কের যাত্রীদের ভোগান্তি দূর হতে অনেক সময় লাগবে। জনগণের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হতে পারে। তখন ম্যানুয়ালি অপারেট করে সময়সীমা কম-বেশি নির্ধারণ করা যাবে।
সিস্টেম যেভাবে কাজ করবে
রাজধানীর সড়কগুলোতে কোন সময়ে কী পরিমাণ যানবাহন চলাচল করে, এসব বিষয়ে কয়েক মাস ধরে জরিপ করেছে বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা। জরিপের তথ্য অনুযায়ী ট্রাফিক সিগন্যাল পয়েন্টে যানবাহন চলাচলের জন্য পিক এবং অফ পিক আওয়ারের জন্য আলাদা আলাদা করে সময়সীমা নির্ধারণ করা হচ্ছে। একেকটি সিগন্যাল পয়েন্টে যানবাহনের চাপ এবং পিক-অফ পিক বিবেচনায় সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে সাইকেল।
প্রতিটি সাইকেলের সময়সীমা হবে সর্বনিম্ন দুই মিনিট থেকে সর্বোচ্চ তিন মিনিট। উদাহরণস্বরূপ কারওয়ানবাজার এলাকার সোনারগাঁও মোড়ে চারটি সড়ক রয়েছে। এই চার সড়কের জন্য তিন মিনিট সময় বরাদ্দ থাকবে। পিক-অফ পিক আওয়ার এবং জরিপে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রতিটি সড়কের জন্য নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ থাকবে। সবুজ বাতি জ্বললে একটি সড়কে যানবাহন পার হওয়া শুরু করবে। তারপর হলুদ বাতি জ্বলবে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে লাল বাতি জ্বলে উঠলে ওই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হবে। এরপর অন্য আরেকটি সড়কে যানবাহন চলাচল শুরু হবে।
সেটা শেষ হলে আরেকটিতে যানবাহন চলাচল শুরু হবে। এভাবে চারটি সড়কে যানবাহন চলাচল শেষ হলে একটা সাইকেল পূর্ণ হবে। এই সাইকেল শেষ হওয়ার পর পথচারী পারাপার শুরু হবে। একটি সাইকেল শেষ হলে পথচারী পারাপারের জন্য পিক এবং অফ পিক আওয়ার অনুযায়ী সর্বনিম্ন ২০ সেকেন্ড থেকে সর্বোচ্চ ৪০ সেকেন্ড সময় দেওয়া হবে। পথচারী পারাপারের সময় চারদিকের সব সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। পথচারী পারাপারের সময় মনোরম মিউজিকের সুর বাজতে থাকবে। তারপর আবারও একই নিয়মে সাইকেল শুরু হবে। শুরু হবে যানবাহন চলাচল।
ট্রাফিক পুলিশ কী করবেন
ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা হাত দিয়ে গাড়ি চলাচল এবং থামানোর কাজ করবেন না। তবে প্রতিটি সিগন্যাল পয়েন্টে সার্জেন্ট এবং স্বল্পসংখ্যক ট্রাফিক সদস্য থাকবেন। কোনো গাড়ি ট্রাফিক বাতির সিগন্যাল অমান্য করলে আইনগতভাবে জরিমানা করবেন তারা। তাৎক্ষণিকভাবে আইন অমান্যকারী যানবাহনকে ধরতে না পারলে ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখে ওই গাড়িকে জরিমানার আওতায় আনা হবে।
পুলিশ বক্সে স্থাপিত স্বয়ংক্রিয় কন্ট্রোল বক্স এ বুয়েটের নিয়োগপ্রাপ্ত অপারেটরের সঙ্গে থেকে শিফট অনুযায়ী ট্রাফিক সদস্যরা অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন। পুরোপুরি এক্সপার্ট হয়ে গেলে বুয়েট অপারেটররা ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন। এরপর পরিপূর্ণভাবে দায়িত্ব পালন করবেন ট্রাফিক সদস্যরা। ক্রমান্বয়ে সিগন্যাল পয়েন্ট থেকে ট্রাফিক ফোর্স কমিয়ে অন্যান্য জরুরি কাজে নিয়োগ করা হবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: