টিআরটি ওয়ার্ল্ডের প্রতিবেদন
ভারতে নতুন ওয়াক্ফ আইনে হুমকির মুখে মুসলিম স্বায়ত্তশাসন ও ঐতিহ্য
চলতি এপ্রিল মাসের শুরুতে ভারতের পার্লামেন্টে এক বিতর্কিত আইন পাস করা হয়। এ আইন দেশটির ২০ কোটি মুসলমানের মধ্যে বিক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং তাদের মধ্যে নিজ দেশে অরক্ষিত থাকার অনুভূতিকে জাগ্রত করে।
ভারতে মুসলমানদের ওয়াক্ফ সম্পত্তি নিয়ে এ আইন ভারতের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভার ২৮৮ সদস্যের ভোটে পাস হয়। আইনটি পাস না করার জন্য লোকসভায় তীব্র যুক্তি দিয়ে বিরোধিতা করেন ২৩২ সদস্য।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একে ‘বাঁক পরিবর্তনকারী মুহূর্ত’ হিসেবে বর্ণনা করছেন। তিনি একে তার সরকারের ধর্মীয় ও দাতব্য সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকারিতা আর স্বচ্ছতা নিয়ে আসার বৃহৎ লক্ষ্যের অংশ হিসেবে একে চিত্রিত করার চেষ্টা করছেন।
ওয়াক্ফ সম্পত্তি আইনের মূল কাঠামো ভেঙে ফেলা নতুন সংশোধিত এ আইনকে মুসলমানরা বিতর্কিত হিসেবে মনে করছেন। এর মাধ্যমে ওয়াক্ফ সম্পত্তির ওপর সরকারি নজরদারি জোরদার ও অমুসলিমদের তত্ত্বাবধায়ক কমিটিতে সদস্য করার সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
ভারতীয় মুসলমানরা মনে করছেন, এর মাধ্যমে তাদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে এবং তাদের প্রতি ভারতীয় সরকারের সংযোগকে সমস্যাগ্রস্ত করেছে।
ভারতের রাজনৈতিক দল অল ইন্ডিয়া মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের (মিম) প্রেসিডেন্ট ও লোকসভার সদস্য আসাদউদ্দিন ওয়েইসি এ আইনকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে নিন্দা জানিয়েছেন এবং এর বিরুদ্ধে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন দিয়েছেন।
এদিকে ভারতের উত্তরপ্রদেশের মুজাফফরনগরে ৩০০’র বেশি লোককে এর প্রতিবাদ করায় আইনি নোটিস পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ওয়াক্ফ আইনের প্রতিবাদে প্রতীকী কালো ব্যাজ পরায় ২৪ ব্যক্তিকে দুই লাখ টাকা করে মুচলেখা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এসব ঘটনা এমন সময় ঘটছে যখন ভারতে মসজিদ ও ইসলামি বিভিন্ন স্থাপত্যের ভূমি নিয়ে আইনি এবং রাজনৈতিক বিরোধ বেড়ে চলছে। উত্তরপ্রদেশের বারানসির জ্ঞানবাপি মসজিদ থেকে মথুরার শাহি ঈদগাহ ও সম্বলের শাহি জামে মসজিদসহ পুরো ভারতে মুসলমানদের বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনার ঐতিহাসিক বৈধতাকে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর চ্যালেঞ্জ করার মধ্যেই নতুন সংশোধিত ওয়াক্ফ আইনটি পাস করা হয়েছে।
মুসলিমরা কোনো সম্পদ যদি আল্লাহর নামে কোনো ধর্মীয় বা দাতব্য কাজের জন্য ছেড়ে দেন, তাকে ওয়াক্ফ বলে। দক্ষিণ এশিয়ায় বিপুলসংখ্যক মসজিদ, স্কুল, এতিমখানা ও হাসপাতাল গড়ে উঠেছে এ ওয়াক্ফ সম্পত্তির ওপরে।
ভারতের ওয়াক্ফ সম্পত্তি তদারকি করা ওয়াক্ফ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম অব ইন্ডিয়ার (ওয়ামসি) তথ্য অনুসারে, দেশটিতে বর্তমানে মোট তিন লাখ ৫৬ হাজার ৩৫২টি ওয়াক্ফ সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ উত্তরপ্রদেশে এক লাখ ২৪ হাজার ৮৬৬, কর্নাটকে ৩৩ হাজার ১৪৭ এবং পশ্চিমবঙ্গে সাত হাজার ৬০টি ওয়াক্ফ সম্পত্তি রয়েছে।
ভারতের সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে পুরো দেশে ছড়িয়ে থাকা এ সম্পত্তির মূল্য প্রায় ১৪.২২ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৭৩ হাজারের বেশি ওয়াক্ফ সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ রয়েছে এবং নতুন আইনের মাধ্যমে কুক্ষিগত করার শঙ্কা করা হচ্ছে।
ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতে প্রথম ওয়াক্ফ সম্পত্তি নিয়ে আইন করা হয়। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর প্রথম ১৯৫৪ সালে ভারতীয় ওয়াক্ফ আইন তৈরি হয়, যা ১৯৯৫ ও ২০১৩ সালে দুই দফা সংশোধিত হয়।
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পারসোনাল ল বোর্ডের মুখপাত্র ড. কাসিম ইলিয়াস বলেন, ২০১৪ থেকে বিজেপি সরকার ১৯৯৫ ও ২০১৩ সালের আইন অনুযায়ী ওয়াক্ফ সম্পত্তি সংরক্ষণের নীতি একটি একটি করে বাদ দিতে থাকে। নতুন আইনে মুসলমানদের সংযোগ ছাড়াই তার নাটকীয় গতি বাড়াবে।
ওয়াক্ফ সম্পত্তির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনার জন্য এ আইন করা হয়েছে বলে মোদি সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানো হয়েছে। তবে ড. ইলিয়াস বলেন, সেন্ট্রাল ওয়াক্ফ কাউন্সিল ও রাজ্যের ওয়াক্ফ বোর্ডগুলোই তা যথাযথভাবে তদারকি করছে।
তিনি বলেন, বাস্তবক্ষেত্রে ধর্মীয় ও দাতব্য সম্পত্তির ওপর উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের নিয়ন্ত্রণের দরজা খুলে দিতেই এ আইন করা হয়েছে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: