রাজধানীতে ভোটের প্রচারে উৎসবের আমেজ

নিউজ ডেস্ক প্রকাশিত: ০৮ নভেম্বর ২০২৫ ০৯:১১ এএম

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আমেজ শুরু হয়ে গেছে। চায়ের টং থেকে অফিসের করিডোর পর্যন্ত আলোচনার একটাই বিষয়- ভোট, ভোট আর ভোট! প্রায় দুই দশক পর এমন স্বাধীন নির্বাচনি পরিবেশে মানুষ সত্যিই যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। ধীরে ধীরে শহর ভরে উঠতে শুরু করেছে রঙিন ব্যানার–ফেস্টুনে, প্রার্থীদের হাস্যোজ্জ্বল মুখের পোস্টারে।

রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাইকের প্রচারণা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা রকম নির্বাচনি প্রচারণাও নজরে পড়ছে।

২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ২০০১ সালের পর এটিই প্রথম নির্বাচন, যা নিয়ে মানুষের মাঝে উৎসবের আমেজ লক্ষ করা গেছে। ২০০৮ সালের বস্তা বস্তা টাকার বিনিময়ে ‘প্যাকেজ ডিল’, ২০১৪ সালে ‘অটোপাস’, ২০১৮ সালে ‘নিশি রাতের ভোট’ এবং ২০২৪ সালে ‘আমি বনাম ডামি’ নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছিল পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সেই স্বৈরাচারের পতন হওয়ায় আগামী সংসদ নির্বাচনে নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী ভোটাররা।

গত সোমবার দলের মনোনয়নপ্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশ করে বিএনপি। এর আগে আঞ্চলিকভাবে নিজেদের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছিল জামায়াতে ইসলাম বাংলাদেশ। ফলে বাকি থাকা দলগুলোও নিজেদের অংক অনেকটাই মিলিয়ে রাখছে। সব মিলিয়ে চায়ের টং দোকান থেকে শুরু করে গার্মেন্টস, কারখানা, অফিস হয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যালয় পর্যন্ত সব জায়গায় এখন নির্বাচনি আমেজ। যেসব দলের কার্যালয় ফ্যাসিবাদী শাসনের সময় তালাবদ্ধ ছিল, ছিল জনশূন্য-এখন সেসব কার্যালয়েও ভরপুর নির্বাচনি আমেজ।

বাংলাদেশে রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট চায়ের আড্ডা। তেমন চায়ের দোকানের মালিক মনির মিয়া বলছিলেন, ভাই এবার কিন্তু মনের মতো ভোট দেব। কেউ এসে আর বলতে পারবে না ‘তোর ভোট দিয়ে ফেলছি’। পাশেই বসে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রমজান আহমেদ যোগ করলেন, আমাদের প্রজন্ম তো আসলে ভোট দিতেই পারেনি। এবার মনে হচ্ছে সত্যি আমরা নিজেরা ঠিক করব, কারা আসবে সংসদে।

রাজধানীর পল্টন, বিজয়নগর, ধানমন্ডি, মিরপুর, গুলশানÑসব জায়গাতেই এখন রাজনৈতিক কর্মীদের পদচারণা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রচারণায় ব্যস্ত তারা। এক সময়ের নিষ্প্রাণ দলীয় কার্যালয়গুলো এখন সরগরম। মগবাজারের একটি রাজনৈতিক কার্যালয়ে দেখা গেল, তরুণরা ব্যস্ত সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারণায়, আর প্রবীণরা পরামর্শ দিচ্ছেন কীভাবে জনগণের কাছে পৌঁছানো যায়। অন্যদিকে গুলশানে একটি দলীয় কার্যালয় মুখর মনোনয়নপ্রাপ্তদের পদচারণায়। ইতোমধ্যেই দলটি সারা দেশের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করেছে।

নির্বাচনকে সামনে রেখে তুলনামূলক ছোট দলগুলোর মধ্যে চলছে দফায় দফায় বৈঠক। তারা বসছেন প্রধান দলগুলোর সঙ্গেও। কষছেন হিসাব-নিকাশ ও নানা ছক। প্রধান দুটি দলের একটি করতে চায় বড় নির্বাচনি ঐক্য, অপরটি চায় জয়ের টার্গেটে সর্বোচ্চ কৌশলের মাধ্যমে জোট গঠন করা। এসব নিয়ে জনসাধারণের মাঝেও রয়েছে কৌতূহল। তারা নিয়মিতই চোখ রাখছেন পত্রপত্রিকায়।

রাজধানীর বাইরেও লেগেছে নির্বাচনি আমেজ। উঠান বৈঠক, মিছিল, মিটিংয়ের মাধ্যমে দলগুলো ভোটারদের দিচ্ছে নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি। কারও মূল প্রতিশ্রুতি দুর্নীতিমুক্ত শাসন ও ন্যায়ভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন করার, আবার কারও রয়েছে আইনের শাসন ও মানবাধিকারসহ ৩১ দফা রূপরেখা। অন্যদের রয়েছে বিচার, সংস্কার, নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তসহ নানা প্রতিশ্রুতি।

ভোটারদের মাঝে এবারের নির্বাচন নিয়ে রয়েছে ব্যাপক প্রত্যাশা। ঢাকার বিমানবন্দর এলাকার বাসিন্দা সোনিয়া বেগম বললেন, গত দুই দশকে ভোট বলতে ভয়ই পেয়েছি। এবার মনে হচ্ছে সত্যিই নিরাপদভাবে ভোট দিতে পারব।

অন্যদিকে মিরপুরের তরুণ ভোটার মেহেদি হাসান আবদুল্লাহ কিছুটা সংশয়ে। তিনি জানালেন, উৎসবের আবহ ভালো লাগছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভোটের দিনটা কেমন যাবে, সেটাই আসল প্রশ্ন।

তরুণ ভোটাররাই এবার সবচেয়ে উচ্ছ্বসিত। তারা শুধু ক্যাম্পাসের আড্ডায় বা মিটিং-মিছিলে নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আলোচনায় মেতে উঠেছেন। পছন্দের প্রার্থী ও দলকে নিয়ে বানাচ্ছেন ভিডিও, দিচ্ছেন পোস্টও। ‘আমার ভোট, আমার অধিকার’, ‘আমার ভোট আমি দিব, যাকে খুশি তাকে দিব’ ও ‘জীবনের প্রথম ভোট, আমার দলের পক্ষেই হোক’ প্রভৃতি স্লোগান লক্ষ্য করা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জুড়ে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক মো. তৌফিকুর রহমান বলেন, স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজনৈতিক দলগুলো শেষ কবে মজেছিল এমন নির্বাচনি আমেজে? ২০০৮ সালে? না, তা বলা যাবে না। ২০০৮-এর সেই নির্বাচনে চাপানো ভাব ছিল বেশ খানিকটা। নির্বাচনি ফলে তা টের পেয়েছেন বহুজন। তার আগের নির্বাচন ছিল ২০০১ সালে ভোটার ও প্রার্থীরা মজেছিলেন মন ভরে শেষবারের মতো।

আসন্ন নির্বাচনটিকে ঘিরে আশঙ্কা নেই, এমন নয়। স্পষ্টতই এ নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ। সেই সঙ্গে এ দলের রাজনৈতিক দোসর কয়েকটি দলও থাকতে পারবে না এ নির্বাচনে, প্রকাশ্যে। তাই বলে দলগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতেই থাকছে না, তা হয়তো নয়। এ দলগুলোও থাকবে আসন্ন নির্বাচনে। দলগুলোর যা সামর্থ্য, তা কাজে লাগাতে চাইবে নেতিবাচকতায়, ধ্বংসের কাজে। খুন-গুম-মাফিয়াতন্ত্রের দোসর দলগুলো এবং সেগুলোর নেতাকর্মীরা আসন্ন নির্বাচনে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে, তা মনে রেখেই সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সজাগ, সতর্ক থাকতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক (অব.) ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, ঢাকার এই নির্বাচনি আমেজ শুধু শহরের সাজ নয়, এটি এক ধরনের মানসিক জাগরণও। দীর্ঘদিন পর মানুষ আবার ভোটের মূল্য বুঝতে শুরু করেছে, রাজনীতি নিয়ে কথা বলছে, ভিন্নমত নিয়েও আলোচনা করছেÑযা গণতন্ত্রের প্রাণ।

তিনি আরো বলেন, ২০০৮ সালের বস্তা বস্তা টাকার বিনিময়ে প্যাকেজ ডিল, ২০১৪ সালে অটোপাস, ২০১৮ সালে রাতের ভোট এবং ২০২৪ সালে ‘আমি বনাম ডামি’ নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছিল পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। এবার মানুষ সে অধিকার ফিরে পেয়ে উচ্ছ্বসিত, আনন্দিত ও উজ্জীবিত, যা পুরো দেশ জুড়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার সুন্দর পরিবেশে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ আনন্দকে ধরে রাখবে সেটাই আমার প্রত্যাশা।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর