জুলাই সনদে হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট স্বীকৃতি

নিউজ ডেস্ক প্রকাশিত: ০২ অক্টোবর ২০২৫ ১০:১০ এএম

পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে ‘ফ্যাসিস্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে জুলাই সনদে। সনদে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পাশাপাশি স্বীকৃতি পাচ্ছে বিগত ১৬ বছরে ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন। ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টির জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, লগি-বৈঠার তাণ্ডবে নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেশে ১/১১ সৃষ্টি হয়েছিল।

জুলাই সনদের পরিমার্জিত ভাষ্যে পঁচাত্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে শেখ মুজিবের একদলীয় শাসন কায়েমের বিপরীতে জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ থাকছে। সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামায় নতুন একটি ধারা যুক্ত করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়া দল ক্ষমতায় গেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

গত ১৬ সেপ্টেম্বর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বিএনপির মতামতসহ গৃহীত জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত ভাষ্যে এমনটা থাকছে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে চূড়ান্ত জুলাই সনদ পাঠানোর পর এটিই ভাষ্যগত সংযোজিত, বিয়োজিত, পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত সবশেষ রূপ বলে জানিয়েছে কমিশন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেন, চূড়ান্ত জুলাই সনদ নিয়ে দলগুলো মতামত ও পরামর্শ দিয়েছে। সনদে আমরাও কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি লক্ষ করেছি। সবকিছু বিবেচনা করে সেগুলো সংশোধন করা হচ্ছে। এতে সনদে দলগুলোর মতামতের স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যাবে।

গত ১১ সেপ্টেম্বর দলগুলোর কাছে ঐকমত্য কমিশনের পাঠানো জুলাই সনদের চূড়ান্ত ভাষ্যের পটভূমিতে কিছু সংযোজন আনা হয়েছে। এতে ১৯৭৫ সালে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে একদলীয় বাকশাল গঠন এবং সে বছর সামরিক অভ্যুত্থানের বিষয় ছিল। এর সঙ্গে ১৯৭৬ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও সেখানে ‘১৯৭৮ সালে বহুদলীয় রাজনীতির পুনঃপ্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণের ফলে ১৯৭৯ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়’ অংশ নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে।

সনদের আগের ভার্সনে ২০০৬ সালে ‘কয়েকটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও তৎপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারি ও একটি অস্বাভাবিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়’ বলা হয়েছিল। সেটি সংশোধন করে ‘আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে লগি-বৈঠার তাণ্ডবে দেশে কয়েকটি নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারি ও একটি অস্বাভাবিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ১/১১ সরকার নামে পরিচিত। ফলে নির্বাচন স্থগিত হয়’ যুক্ত করা হয়েছে।

দলগুলোকে দেওয়া চূড়ান্ত সনদের ভাষ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শিশু ও নারীসহ প্রায় ‘এক হাজার’ নাগরিক নিহত হয় উল্লেখ থাকলেও এখন সেটি সংশোধন করে ‘সহস্রাধিক’ করা হচ্ছে। আগের সনদে ‘তাদের আত্মাহুতি, ত্যাগ এবং জনগণের সম্মিলিত শক্তি ও প্রতিরোধের মুখে স্বৈরাচারী শাসক ও তার দোসররা পরাজিত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়’ থাকলেও সংশোধিত সনদে ‘স্বৈরাচারী শাসকের’ স্থলে ‘ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা’ এবং দোসররা পারাজিত হয়ে ‘অনেকেই’ পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় বলা হচ্ছে।

সংস্কার কমিশন গঠন অংশে সংস্কার কমিশনগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লিখিত মতামত এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার প্রতিনিধিসহ অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে তৈরি সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে।

ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম অংশে সংলাপের ভিত্তিতে জুলাই সনদে সন্নিবেশিত করতে দলগুলোর সম্মত (কিছু বিষয়ে ভিন্নমতসহ) হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের বীর শহীদ ও আহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর আগে ‘২০০৯ সাল পরবর্তী ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের’ কথা নতুন করে যুক্ত করা হচ্ছে সনদে।

গত ১১ সেপ্টেম্বর দলগুলোর কাছে পাঠানো জুলাই সনদের চূড়ান্ত ভাষ্যে সংলাপে ঐকমত্য হওয়া ৮৪টি প্রস্তাব উল্লেখ করা হয়। তবে সংশোধিত সনদের সবশেষ ভাষ্যে চারটি কমিয়ে ৮০টি উল্লেখ করা হচ্ছে। কমিশন সূত্র বলছে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়োগের প্রস্তাবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় চারটি প্রস্তাব বাদ দেওয়া হচ্ছে। বাকি ৮০টি প্রস্তাবে দলগুলোর দেওয়া ‘নোট অব ডিসেন্ট’ সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ থাকছে।

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে পুলিশি সেবাকে জনবান্ধব করতে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনে দলগুলো একমত হলেও সনদের আগের ভার্সনে কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া উল্লেখ ছিল না। পরে রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শে সংশোধিত ভাষ্যে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। পুলিশ কমিশন গঠনের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, পুলিশ যাতে আইনানুগভাবে এবং প্রভাবমুক্তভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে, পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিষ্পত্তি, পুলিশের বিরুদ্ধে নাগরিকদের অভিযোগ নিষ্পত্তি করবে। ৯ সদস্যের কমিশনের কমপক্ষে দুজন নারী রাখার কথা বলা হয়েছে। যার চেয়ারম্যান হবেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। সদস্য সচিব হিসেবে পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শকের নিচে নয় এমন কর্মকর্তা, যার বয়স ৬২ বছরের বেশি হবে না। সদস্য হিসেবে থাকবেন সংসদ নেতা, বিরোধীদলীয় নেতা এবং স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের একজন করে প্রতিনিধি, একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা বা উচ্চ আদালতের তালিকাভুক্ত আইনজীবী এবং একজন মানবাধিকারকর্মী।

দলগুলোর কাছে পাঠানো চূড়ান্ত জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামায় সাতটি ধারার সঙ্গে নতুন করে আরেকটি ধারা যুক্ত করা হচ্ছে। ৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদের যেসব ক্ষেত্রে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়া হয়েছে, জাতীয় নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট প্রাপ্ত হলে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল সে মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে পারবে। এক্ষেত্রে যেসব দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে তারা ক্ষমতায় গেলে ঐকমত্য কমিশনে দেওয়া তাদের প্রস্তাব অনুসারে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর