নিউইয়র্কে ফখরুলের ঢাল হলো জামায়াত-শিবির; ছিলনা বিএনপির প্রটোকল

নিউজ ডেস্ক প্রকাশিত: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১২:০৯ পিএম

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে পৌঁছেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার সফরসঙ্গী হিসেবে ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, তারেক রহমানের উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন

তবে এই সফরের শুরুর দিনেই নিউইয়র্কে অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মুখে পড়েন বিএনপি ও এনসিপির নেতারা। আগেই ঘোষণাকৃত কর্মসূচি অনুযায়ী, জন এফ কেনেডি (জেএফকে) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবস্থান নেয় যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ। তারা ড. ইউনূসের সফরসঙ্গী নেতাদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরনের স্লোগান, কটূক্তি এবং প্রতিবাদমূলক আচরণ শুরু করে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে মির্জা ফখরুল, আখতার হোসেন ও তাসনিম জারা আলাদা আলাদাভাবে হাঁট ছিলেন। তারা কেউই নিজ দলীয় প্রবাসী কর্মীদের সংগঠিত উপস্থিতি বা নিরাপত্তা বলয়ের সুবিধা পাননি। এ সময় বিক্ষোভকারীরা কাছাকাছি চলে এসে তাদের ঘিরে ধরে এবং অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করে।

বিশেষ করে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেনকে লক্ষ্য করে ডিম ছোড়া হয়। এই দৃশ্য ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা গেছে। তাকে উদ্দেশ্য করে বেশ কিছু অপমানজনক স্লোগান ও গালিও শোনা যায়। যদিও মির্জা ফখরুল ও তাসনিম জারাকে সরাসরি আক্রমণ করা হয়নি, তবে মৌখিকভাবে অপদস্থ করার চেষ্টা হয় বলেই প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরকে ঘিরে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। তার বিমানবন্দর ত্যাগের সময় চারপাশে ঘিরে ছিলেন জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রশিবির সংশ্লিষ্ট যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী নেতাকর্মীরা। ভিডিওতে দেখা গেছে, সংগঠিতভাবে তারা তাহেরকে নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে নেন। ফলে তাকে কোনো প্রকার গালাগালি, হামলা বা বিশৃঙ্খলায় পড়তে হয়নি।

প্রত্যক্ষদর্শী ও যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী কয়েকজন অ্যাক্টিভিস্ট জানিয়েছেন, মির্জা ফখরুল বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে কিছুদূর এগোনোর পরই একদল আওয়ামী লীগপন্থী কর্মী তাকে উদ্দেশ্য করে গালিগালাজ করতে করতে এগিয়ে আসে। তখন পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এমন সময়, ডা. তাহেরকে ঘিরে থাকা জামায়াত-শিবিরের একটি দল দ্রুত ছুটে আসে মির্জা ফখরুলের দিকে। তারা শুধু ফখরুল নন, তার সঙ্গে থাকা তাসনিম জারা এবং আখতার হোসেনকেও ঘিরে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে। পরে তারা তিনজনকে সংগঠিতভাবে গাড়ির দিকে এগিয়ে দেন এবং ঘটনাস্থল ত্যাগে সহায়তা করেন।

ফ্রান্সপ্রবাসী অ্যাক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি ভিডিও শেয়ার করেছেন, যেখানে দেখা যায়—মির্জা ফখরুলের সামনে থেকে প্রটোকল দিচ্ছেন জামায়াত-শিবিরের এক নেতা। তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক দায়িত্বশীল বলে শনাক্ত করা গেছে। ভিডিওতে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘স্যার! আমরা জামায়াত-শিবিরের লোকজন চলে এসেছি। আপনার চিন্তার কোনো কারণ নেই।’

ঘটনাটি সামাজিকমাধ্যমে আলোচনার জন্ম দেয়। অনেকেই বলছেন, এই প্রটোকল ও তাৎক্ষণিক দায়িত্ব গ্রহণ না হলে মির্জা ফখরুলদের পরিস্থিতি আরও বিব্রতকর হতে পারত। প্রবাসী সাংবাদিক নাজমুস সাকিব লিখেছেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী হয়ে বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কয়েকজন শীর্ষ নেতা নিউইয়র্কে পৌঁছান। তিনি মন্তব্য করেন, একটি বড় দল হিসেবে নিউইয়র্কে আওয়ামী লীগের প্রতিবাদী অবস্থানের মুখে বিএনপির পক্ষ থেকে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী প্রতিরোধ আশা করাই ছিল স্বাভাবিক। তবে বাস্তবতা ছিল ঠিক উল্টো।

নাজমুস সাকিব জানান, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহেরকে প্রবাসী জামায়াতপন্থী কর্মীরা সুশৃঙ্খলভাবে নিরাপদে বিমানবন্দর থেকে সরিয়ে নিতে পারলেও, বিএনপি ও এনসিপির নেতারা এমন কোনো সহযোগিতা পাননি। বরং তারা বিমানবন্দরেই আওয়ামী লীগপন্থী নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়েন। ড. ইউনূস নিজে তার নির্ধারিত প্রটোকল ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্বিঘ্নে স্থান ত্যাগ করলেও, সফরসঙ্গীদের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো গুরুত্ব দেননি বলে অভিযোগ করেন তিনি।

তথ্যমতে, এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা এবং সদস্য সচিব আখতার হোসেন বিমানবন্দরের বাইরে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ডিম নিক্ষেপ ও কটূক্তির শিকার হন। তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কোনো যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি নেতাকর্মী সেসময় উপস্থিত ছিলেন না বলেও দাবি করেন নাজমুস সাকিব। তার মতে, এনসিপি যুক্তরাষ্ট্রে ছোট একটি দল, তাদের জনভিত্তি নেই বললেই চলে। কিন্তু বিএনপি বড় দল হিসেবে এ সময়ে ‘ঢাল’ হয়ে দাঁড়াতে পারত, যা তারা করতে পারেনি।

তিনি আরও দাবি করেন, ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি ছবিতে দেখা গেছে, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের চারপাশে বিক্ষোভকারী আওয়ামী লীগ কর্মীরা অবস্থান করছিলেন, অথচ বিএনপির কেউ তাকে ঘিরে রাখেনি। এর বিপরীতে জামায়াত সুপরিকল্পিতভাবে মাঠে ছিল এবং বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে কৌশলী ও কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে।

সবশেষে নাজমুস সাকিব মন্তব্য করেন, দেশের ভেতরে যেমন, তেমনি দেশের বাইরে—জামায়াতে ইসলামীর সংগঠন ও শৃঙ্খলা এখনো অটুট, যেখানে বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রে কার্যত একটি ‘অযোগ্য নেতৃত্ব নির্ভর’ ও ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ দলে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির আলোচিত নেতা গিয়াসের দায়িত্বহীনতা এবং অব্যবস্থাপনাকেই তিনি এর জন্য দায়ী করেন। এমন নেতাদের ওপর নির্ভর করে বিএনপি যদি ভবিষ্যতের রাজনীতি সাজায়, তবে তা দলের জন্য ফলপ্রসূ হবে না বলেই মত দিয়েছেন তিনি।

ফ্রান্সপ্রবাসী অ্যাক্টিভিস্ট পিনকী ভট্টাচার্য নিউইয়র্কে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের আগমনের সময়কার পরিস্থিতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেন, আওয়ামী লীগ আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল যে তারা বিমানবন্দরে অবস্থান নেবে। এরপরও বিএনপির কেউ মির্জা ফখরুলকে রিসিভ করতে যাননি, এটি অবাক করার মতো বিষয়।

তার মতে, যদিও ফখরুলের ওপর সরাসরি ডিম নিক্ষেপ হয়নি, তবে তাকে ঘিরে যে ধরনের অপমানজনক আচরণ হয়েছে, তা কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। পিনকী লিখেন, ‘খেয়াল করে দেখেন, জামায়াতের কেউ এভাবে যায় নাই। তাদের নিরাপত্তার সিস্টেম ঠিকই ছিল।’

পিনকী ভট্টাচার্য এ সময় ড. ইউনূসের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তিনি অভিযোগ করেন, সফরসঙ্গী হিসেবে যাদের নিউইয়র্কে নিয়ে গেছেন, তাদের সঙ্গে একসঙ্গে হোটেলে না গিয়ে ড. ইউনূস একা তার নির্ধারিত প্রটোকল ব্যবস্থায় চলে যান। তিনি বলেন, প্রফেসর ইউনূস এতটাই স্বার্থপর যে, সফরসঙ্গীদের নিরাপত্তা ও সম্মানের বিষয়টি একেবারেই উপেক্ষা করেছেন।

তিনি আরও দাবি করেন, নিউইয়র্কে বাংলাদেশ দূতাবাসের ভূমিকাও ছিল হতাশাজনক। তার ভাষ্য মতে, ‘দূতাবসে তো ডেইলি স্টারের গোলাম মুর্তজারে বসায়ে রাখছে। কোন আক্কেলে অ্যাম্বাসির লোকেরা এইভাবে উনাদের হাঁটায়ে এই রাস্তা দিয়ে বাইর করতেছে?’

পিনকী ভট্টাচার্য মন্তব্য করেন, এই ধরনের পরিস্থিতি যে ঘটতে যাচ্ছে, তা অনেক আগেই নিশ্চিত করেছিলেন আসিফ নজরুল, ছাত্রনেতা ওয়াকার ও সংশ্লিষ্ট অন্যরা। তিনি লিখেন, ‘অপদার্থের হাতে রাষ্ট্রটা তুলে দেয়ার খেসারত এখন পুরো জাতিকে দিতে হচ্ছে। তবে খুব বেশিদিন নয়, বিপ্লবীরা রাষ্ট্রের দখল নেবে।

যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত সাংবাদিক আবুল কালাম লিখেন, ‘নিউইয়র্কে হামলা থেকে মির্জা ফখরুলের প্রাণ রক্ষায় জামায়াত-শিবির ঢাল না হলে, আজ অন্য কিছু ঘটতে পারতো।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে বিএনপি নেতাদের নিরাপত্তা সংকট দেখা দেওয়ার পর, জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রশিবিরপন্থী নেতাকর্মীরা তাৎক্ষণিকভাবে দায়িত্ব নেয়। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত এই রাজনৈতিক কর্মীরা ডানপন্থী মতাদর্শের অংশ হিসেবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরাসরি মাঠে নেমে পড়েন।

স্থানীয় সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, ডানপন্থী রাজনীতির অনুসারীরা যখনই চাপে পড়েন কিংবা হামলার শিকার হন, তখন জামায়াত-শিবিরপন্থীরা ঢাল হিসেবে দাঁড়ান—এমন উদাহরণ আগেও ছিল, এবারও নিউইয়র্কে তার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।

বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মারুফ হোসেন। তিনি নিউইয়র্কে থাকা দলীয় কর্মীদের নেতৃত্ব দেন এবং মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্য নেতাদের ঘিরে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেন। ঘটনার সময়কার একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, মারুফ হোসেন নিজেই সামনে থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন এবং সফরসঙ্গী নেতাদের নিরাপদে গাড়ির দিকে এগিয়ে দেন।

LIMON

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর