পাল্টে যাচ্ছে বিমান চলাচলের হিসাব-নিকাশ

নিউজ ডেস্ক প্রকাশিত: ১৫ জুলাই ২০২৫ ২১:০৭ পিএম

বহু দশক ধরে উড়োজাহাজ চলাচলে অন্যতম নির্ভরতা ছিল স্যাটেলাইটভিত্তিক নেভিগেশন ব্যবস্থা ‘গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম’ বা জিপিএস। কিন্তু এখন জিপিএস জ্যামিং ও স্পুফিং (ভুয়া সংকেত পাঠিয়ে বিভ্রান্ত করা) বেড়ে যাওয়ায়, আকাশপথকে আরও নিরাপদ করতে বিকল্প উপায় খুঁজতে হচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে, এয়ারবাসের সিলিকন ভ্যালিভিত্তিক গবেষণা শাখা অ্যাকিউবেড এবং গুগল-এর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও কোয়ান্টাম প্রযুক্তিনির্ভর সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্যান্ডবক্সএকিউ একটি নতুন পদ্ধতি পরীক্ষা করছে। এটি একটি ছোট বাক্সের মতো যন্ত্র যাতে আছে লেজার, একটি জিপিইউ চিপ এবং পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র সম্পর্কে গভীর পর্যালোচনা। এই প্রযুক্তির নাম কোয়ান্টাম সেন্সিং। এটি দীর্ঘদিন গবেষণার বিষয় হলেও এখন বাণিজ্যিকভাবে বিমান চলাচলে ব্যবহৃত হতে যাচ্ছে।

অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে কীভাবে কাজ করে এই কোয়ান্টাম সেন্সিং যন্ত্র। ম্যাগনাভ নামে পরিচিত এই যন্ত্রটি পৃথিবীর ভূত্বকের বিভিন্ন স্থানে থাকা স্বতন্ত্র চৌম্বকীয় শক্তি পরিমাপ করে। এই পদ্ধতিতে লেজার আলোক কণা (ফোটন) একটি ইলেকট্রনের ওপর নিক্ষেপ করা হয়। লেজার বন্ধ হলে ইলেকট্রন সেই কণাটি ফিরিয়ে দেয় এবং এর সঙ্গে চৌম্বকক্ষেত্র অনুযায়ী একটি স্বতন্ত্র সংকেত উৎপন্ন হয়। প্রতিটি জায়গার চৌম্বক সংকেতই ভিন্ন রকম হয় পৃথিবীর অভ্যন্তরে থাকা আয়রন কণার কারণে। এই সংকেতগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই অ্যালগরিদম বিশ্লেষণ করে এবং মানচিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে সুনির্দিষ্ট অবস্থান জানিয়ে দেয়।

অ্যাকিউবেড সম্প্রতি একটি বিচক্র্যাফট ব্যারন উড়োজাহাজে এই যন্ত্রটি বসিয়ে ১৫০ ঘণ্টার বেশি সময় যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে উড়িয়েছে। দেখা গেছে, এটি বিমানকে দুই নটিক্যাল মাইলের মধ্যে অবস্থান শনাক্ত করতে পেরেছে শতভাগ ক্ষেত্রে, এবং ৫৫০ মিটার মধ্যে শনাক্ত করেছে ৬৪ শতাংশ ক্ষেত্রে।
স্যান্ডবক্সএকিউ-এর প্রধান নির্বাহী জ্যাক হিডারি বলেন, ‘প্রযুক্তি কাজ করে সেটা প্রমাণ করাই ছিল সবচেয়ে কঠিন কাজ।’

প্রথমে এই প্রযুক্তি সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হবে, পরে বাণিজ্যিক বিমান চলাচলেও তা যুক্ত করা হতে পারে। কারণ জিপিএস বিকল বা ভুয়া সংকেত দেখালে বিমানগুলোর বিকল্প দিকনির্দেশনার উপায় থাকা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।

জিপিএস বনাম কোয়ান্টাম সেন্সিং: জিপিএস মূলত উপগ্রহ থেকে পাঠানো ডিজিটাল সংকেতের ওপর নির্ভর করে, যা সহজেই জ্যাম বা স্পুফ করা যায়। কিন্তু ম্যাগনেভ যন্ত্রটি সম্পূর্ণ অ্যানালগ। এর সংকেত বাইরের কোনও উৎস থেকে আসে না, বরং সরাসরি পৃথিবীর প্রাকৃতিক চৌম্বক শক্তি থেকে আসে-যা নকল করা একেবারেই অসম্ভব।

এটি কেবল বিমান চলাচলেই সীমাবদ্ধ নয়। ইওয়াই-এর গ্লোবাল ইনোভেশন অফিসার জো ডেপা বলেন, ‘সামরিক ক্ষেত্রে এটি গোপন সাবমেরিন বা টানেল শনাক্ত করতে, এমনকি স্বাস্থ্য খাতে মস্তিষ্ক ও হৃদপিণ্ডের ক্ষীণ চৌম্বক সংকেত শনাক্ত করে অতিরিক্ত পরীক্ষা ছাড়াই রোগ নির্ণয় করতেও সহায়ক হতে পারে।

জ্যাক হিডারি আরও বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে জিপিএস বিকল হওয়ার ঘটনা বাড়ছে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, ইউক্রেন ও রাশিয়ায় বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, যেখানে সামরিক বাহিনীগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে জ্যামিং করছে। এই বাস্তবতায়, পৃথিবীর নিজস্ব চৌম্বকতা ব্যবহার করে তৈরি হওয়া এই প্রযুক্তি আগামী দিনের বিমান চলাচলে বিপ্লব আনতে পারে। আমরা বলছি না যে এটি জিপিএসকে পুরোপুরি বদলে দেবে। তবে জিপিএস বিকল বা স্পুফ হলে এটি হতে পারে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাকআপ।’

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর