ইরানে হামলার ‘ইসরায়েলি বাহানা’ আন্তর্জাতিক আইনে ‘অবৈধ’:এক্সপ্লেইনার

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ানোর কথা ভাবছেন। তারা দাবি করছেন তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করার চেষ্টা করছেন। তাদের ভাষ্য- ইরান ‘পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির খুব কাছে’ পৌঁছে গেছে।
ইসরায়েল বলছে, তারা গত এক সপ্তাহে ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে, কারণ তারা আগাম প্রতিরোধমূলক হিসেবে ইরানি পারমাণবিক হামলার আশঙ্কা করছে। কিন্তু এটা কি বৈধ যুক্তি?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জাতি রাষ্ট্রগুলোর অধিকার সংরক্ষণের মূল নথি জাতিসংঘ সনদ, যা আক্রমণাত্মক যুদ্ধকে নিষিদ্ধ করে এবং শুধু আত্মরক্ষার জন্য সামরিক পদক্ষেপের অনুমতি দেয়।
জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী, যদি বিরোধপূর্ণ দেশগুলো শান্তিপূর্ণভাবে তাদের মতবিরোধ মেটাতে ব্যর্থ হয়, তখন শুধু জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদই সিদ্ধান্ত নিতে পারে সেদেশে কোনো সামরিক পদক্ষেপ বৈধ কি না।
তবে যদি কোনো দেশ নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনার সময় আক্রমণের শিকার হয়, তাহলে সেই দেশ বা তার মিত্রদের ‘ব্যক্তিগত বা সম্মিলিত আত্মরক্ষার অন্তর্নিহিত অধিকার’ রয়েছে।
ফলে ইসরায়েলের ইরানের ওপর হামলার আইনি বৈধতা নির্ভর করছে, তারা এই হামলাকে ‘আগাম আত্মরক্ষা’ হিসেবে যথাযথভাবে যুক্তি দিয়ে তুলে ধরতে পারে কি না, তার ওপর।
এখন প্রশ্ন হলো, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলের হামলা কি আত্মরক্ষার যৌক্তিকতা বহন করে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “না।”
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংসের পরিকল্পনা বিবেচনা করছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, ইরান খুব দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে ফেলতে পারে এবং সেই সম্ভাবনার কারণেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
গত এক সপ্তাহে ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েল ব্যাপক মাত্রায় হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েল বলছে, এই পদক্ষেপ ছিল একটি সম্ভাব্য ইরানি পারমাণবিক হামলার আগাম প্রতিক্রিয়া। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এই আগাম হামলা কি আন্তর্জাতিক আইনে বৈধ?
জাতিসংঘ সনদ কোনো আক্রমণাত্মক যুদ্ধকে বৈধতা দেয় না। সেখানে বলা হয়েছে, কেবল আত্মরক্ষার ক্ষেত্রেই বলপ্রয়োগ বৈধ। এ ছাড়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদই একমাত্র কর্তৃপক্ষ, যারা নির্ধারণ করতে পারে কোনো সামরিক পদক্ষেপ বৈধ কি না; তাও কেবল তখন, যখন শান্তিপূর্ণ সমাধানের সব পথ ব্যর্থ হয়ে যায়।
ইসরায়েল এবং তার মিত্ররা ইরানে হামলাকে কি ‘আগাম আত্মরক্ষা’ হিসেবে বৈধতা দিতে পারে?
রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ের অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আইসিসি প্রাক্তন সদস্য মার্কো মিলানোভিচ বলেছেন, “এটি এমন পরিস্থিতি নয়, যেখানে ইসরায়েল সরাসরি বা হুথিদের মতো ইরানের কোনো সহযোগী গোষ্ঠীর হামলার মুখে পড়েছে।”
তিনি আরো লিখেছেন, “এমন কোনো প্রমাণ নেই যে ইরান অনিবার্যভাবে ইসরায়েলের ওপর পারমাণবিক হামলা চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।”
“এমনকি যদি এইরকম কোনো উদ্দেশ্য ধরেও নেওয়া হয়, তাহলেও ইসরায়েলের উচিত ছিল আরো প্রমাণ উপস্থাপন করা। বর্তমান পরিস্থিতিতে বল প্রয়োগ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না, এমন যুক্তি টেকসই নয়।”
“আত্মরক্ষার সবচেয়ে বিস্তৃত (তথাকথিত আইনি) ব্যাখ্যাও যদি ধরা হয়, তাহলেও ইসরায়েলের এই হামলা আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ,” যোগ করেন তিনি।
এই মতকে সমর্থন করে যুক্তরাজ্যের প্রধান আইন উপদেষ্টা রিচার্ড হারমার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারকে পরামর্শ দিয়েছেন, “যতক্ষণ না আমাদের বাহিনী সরাসরি আক্রমণের শিকার হয়, ততক্ষণ ইরানে কোনো হামলায় যুক্ত হওয়া আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।”
অ্যাথেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক মারিয়া গাভুনেলি আলজাজিরাকে বলেন, “আসন্ন হামলার আশঙ্কায় আগাম আত্মরক্ষা আন্তর্জাতিক আইনে বৈধ নয় এবং আমরা সবাই এই বিষয়ে অত্যন্ত পরিষ্কার।”
তবে তিনি উল্লেখ করেন, পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম আলোচনা হয়েছে।
“যদি নিশ্চিত প্রমাণ থাকে যে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি হচ্ছে এবং তা ব্যবহারের কাছাকাছি, তাহলে সীমিত ব্যতিক্রম হিসেবে আত্মরক্ষার যুক্তি মানা যেতে পারে।”
“ইসরায়েল যদি বলে তারা অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে, তাহলে তাদের উচিত ছিল আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি সংস্থার পক্ষ থেকে উপযুক্ত প্রমাণ তুলে ধরা।”
ইরানে আগাম হামলার পক্ষে ইসরায়েলের যুক্তি টেকসই নয়
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলা নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র বিতর্ক তৈরি হয়েছে। দেশটি দাবি করছে, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির আশঙ্কায় তারা ‘আত্মরক্ষামূলক আগাম প্রতিরোধমূলক হামলা’ চালাতে বাধ্য হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা এই যুক্তিকে কার্যত বাতিল করে দিয়েছেন।
আগাম আত্মরক্ষা আইনগতভাবে বৈধ নয়
রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইনবিষয়ক অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রাক্তন সদস্য মার্কো মিলানোভিচ লিখেছেন, “ইসরায়েল এই যুক্তি দিতে পারছে না যে, ইরানের হামলা আসন্ন।”
তিনি আরো বলেন, “এমন কোনো শক্ত প্রমাণ নেই যে ইরান পরমাণু অস্ত্র বানিয়ে তা ব্যবহার করে ইসরায়েলের ওপর হামলা চালানোর অটল সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
“আর এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলেও যদি ধরে নেওয়া হয়, তবু ইসরায়েলের পক্ষে এই মুহূর্তে বলপ্রয়োগই একমাত্র উপায় ছিল, এমন দাবি টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।”
মার্কো মিলানোভিচ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, “আত্মরক্ষার সবচেয়ে প্রশস্ত আইনগত ব্যাখ্যা ধরেও দেখলে ইসরায়েলের এই শক্তি প্রয়োগ আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ।”
যুক্তরাজ্যের আইনি পরামর্শ: হামলায় না জড়ানোর আহ্বান
স্কাই নিউজ জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যের প্রধান আইন উপদেষ্টা রিচার্ড হারমার প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারকে সতর্ক করে বলেছেন, “যতক্ষণ না আমাদের নিজস্ব সেনাদের ওপর সরাসরি হামলা হয়, ততক্ষণ ইরানে কোনো সামরিক পদক্ষেপে যুক্ত হওয়া আইনগতভাবে অবৈধ।”
‘আন্তর্জাতিক আইনে আগাম হামলার বৈধতা নেই’
অ্যাথেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইন অধ্যাপক মারিয়া গাভুনেলি এ বিষয়ে বলেন, “আসন্ন হামলার আশঙ্কায় আত্মরক্ষামূলক আগাম হামলা চালানো আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ এবং এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অত্যন্ত স্পষ্ট।”
তবে তিনি স্বীকার করেন, পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে একধরনের ‘বিশেষ ব্যতিক্রম’ হিসেবে আলোচনা চলে আসছে।
তিনি বলেন, “যদি প্রমাণ থাকে যে একটি পরমাণু অস্ত্র তৈরি হচ্ছে, তাহলে নিয়মের একটি ব্যতিক্রম হিসেবে আগাম আত্মরক্ষার প্রশ্ন তোলা যেতে পারে।”
তবে এমন পরিস্থিতিতেও বিশ্বস্ত, নিরপেক্ষ প্রমাণ থাকা জরুরি।
আইএইএর প্রমাণ ছাড়া ইসরায়েলের যুক্তি টিকবে না
গাভুনেলি আরো বলেন, “ইসরায়েল যদি দাবি করে যে তাদের অস্তিত্বই ঝুঁকির মুখে, তাহলে সেই দাবির পক্ষে তাদের আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা র কাছ থেকে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ হাজির করতে হবে।”
আইএইএ কি ইরান পারমাণবিক বোমা বানাচ্ছে, এই বিষয়ে কোনো প্রমাণ দিয়েছে?
আন্তর্জাতিক আনবিক সংস্থা-আইএইএ বলেছে, তারা ইরান কী করছে, তা যাচাই করতে পারছে না। তবে সংস্থাটি এখন পর্যন্ত স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়নি যে, ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে।
ইরান ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়, যখন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি বাতিল করে দেন। এই চুক্তিটি ছিল জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকমন (জেসিপিওএ), যা ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে হয়েছিল।
গত ৯ জুন আইএইএর মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি বলেন, ইরান বারবার প্রশ্নের উত্তর দেয়নি, অথবা প্রযুক্তিগতভাবে গ্রহণযোগ্য উত্তর দেয়নি। বিশেষ করে তিনটি স্থানে (ভারামিন, মারিভান ও তুর্কুজাবাদে মানবসৃষ্ট ইউরেনিয়াম কণার উপস্থিতি নিয়ে আইএইএ যে প্রশ্ন তুলেছিল, তার স্পষ্ট জবাব দেয়নি ইরান।
ইরান ওই সবস্থান পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছে, যা তদন্তকে আরো কঠিন করে তুলেছে।
গ্রোসি ইরানের 'দ্রুত হারে উচ্চমাত্রার ইউরেনিয়াম মজুত'কে 'গুরুতর উদ্বেগ' হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।
ফোরদো ও নাতাঞ্জে ৬০ শতাংশ মাত্রার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে গ্রোসি উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেনন। ২০২৩ সালে আইএইএ ফোরদতে যে ৮৩.৭ শতাংশ মাত্রার ইউরেনিয়াম কণার উপস্থিতি খুঁজে পেয়েছিল, তাও উদ্বেগের কারণ ছিল।
পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়ামের মাত্রা কমপক্ষে ৯০ শতাংশ হওয়া অপরিহার্য।
জেসিপিওএ চুক্তি অনুযায়ী, ইরান কেবল ৫ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারত।
২০২৫ সালের ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর ঠিক আগেই আইএইএ একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, যাতে ঘোষণা করা হয় তেহরান আন্তর্জাতিক পরমাণু নিরাপত্তা মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে না।
তবে এই সপ্তাহে রাফায়েল গ্রোসি স্পষ্ট করে বলেন, “আমরা ইরানের পরমাণু অস্ত্র নির্মাণের কোনো প্রমাণ পাইনি।”তিনি যোগ করেন, “পরমাণু অস্ত্রে রূপান্তরের লক্ষ্যে ইরানের কোনো সংগঠিত প্রচেষ্টার প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।”
ইরানের প্রতিক্রিয়া
ইরান দাবি করেছে, তারা পারমাণবিক অস্ত্র না তৈরির প্রতিশ্রুতি সংবলিত চুক্তি বা পারমাণবিক অস্ত্র প্রসারের বিরোধী চুক্তির (এনপিটি) সদস্য দেশ। এই চুক্তি অনুযায়ী, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি বা অধিগ্রহণ করবে না।
তেহরানের দাবি, উচ্চমাত্রার ইউরেনিয়ামের কণা পাওয়া গেছে সাবোটাজ বা শত্রুতাপূর্ণ কর্মকাণ্ডের ফলে।
ইসরায়েলের হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা করেছে, সংসদ সদস্যরা এনপিটি থেকে ইরানকে প্রত্যাহার করার একটি প্রস্তাবিত বিল নিয়ে কাজ করছেন।
'আগাম আত্মরক্ষা' আগেও হামলার যুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে কি?
১৯৮১ সালে ইসরায়েল ইরাকের অসমাপ্ত ওসিরাক পারমাণবিক চুল্লিতে হামলা চালায়, যেটি ফরাসি বাণিজ্যিক অংশীদারিত্বে নির্মিত হচ্ছিল। তখন ইসরায়েল ওই হামলাকে ‘আগাম আত্মরক্ষার’ যুক্তিতে বৈধ বলার চেষ্টা করে।
তবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৪৮৭ নম্বর প্রস্তাবে এই হামলাকে জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন হিসেবে জোরালোভাবে নিন্দা জানায়।
ওই প্রস্তাবে বলা হয়, “এই হামলা ইরাক এবং অন্যান্য দেশের প্রযুক্তিগত ও পারমাণবিক উন্নয়নের সার্বভৌম অধিকারের বিরুদ্ধে।”এছাড়া প্রস্তাবে বলা হয়, ইসরায়েল এনপিটি চুক্তির সদস্য নয়।
বর্তমানে ধারণা করা হয়, ইসরায়েলের হাতে প্রায় ৯০টি পারমাণবিক বোমা রয়েছে। যদিও এই ধারণার কোনো প্রমাণ কেউ এখনো দিতে পারেনি।
২০০৩ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইরাকে আগ্রাসনের পক্ষে আগাম আত্মরক্ষার যুক্তি দেন। তিনি বলেছিলেন, ইরাক ভবিষ্যতে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গণবিধ্বংসী অস্ত্র দিয়ে হামলা চালাতে পারে।
তবে জাতিসংঘ অস্ত্র পরিদর্শকরা স্পষ্টভাবে তখন জানিয়েছিলেন, বুশের দাবির পক্ষে কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এই যুদ্ধকে অনুমোদন দেয়নি, তবু যুক্তরাষ্ট্র ‘কোয়ালিশন অব দ্য উইলিং’ গঠন করে ইরাক আক্রমণ করে। পরবর্তীতে দেখা যায়, ইরাকে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র ছিল না।
২০১৮ সালে ইসরায়েল প্রকাশ করে, তারা ২০০৭ সালে সিরিয়ার একটি পারমাণবিক চুল্লি ধ্বংস করেছিল, যার নির্মাতা ছিল উত্তর কোরিয়া।
‘অপারেশন আউটসাইট দ্য বক্স’ নামে অভিযানের মাধ্যমে সিরিয়ার দেইর আল-জোরে অবস্থিত প্লুটোনিয়াম রিঅ্যাক্টর ধ্বংস করেছিল ইসরায়েল।
ইসরায়েলের দাবি ছিল, তারা সিরিয়ার সম্ভাব্য পারমাণবিক হামলার আগাম প্রতিক্রিয়ায় এই পদক্ষেপ নিয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইনে ব্যক্তির ওপর হামলা কখনো বৈধ হতে পারে?
ইসরায়েল ১৩ জুন ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে জড়িত কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় পদার্থবিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে। ২০১০ সাল থেকে ইরানের আরো অনেক পদার্থবিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীর হত্যাকাণ্ডেও ইসরায়েলের সংশ্লিষ্টতার সন্দেহ করা হয়।
মার্কো মিলানোভিচের মতে, “যে বিজ্ঞানীরা ইরানের সশস্ত্র বাহিনীতে নিয়োজিত, তারা যোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন এবং লক্ষ্যবস্তু হওয়া বৈধ। তবে অধিকাংশ বিজ্ঞানী যারা নিরস্ত্র নাগরিক, তাদের ওপর হামলা করা আন্তর্জাতিক আইনে বৈধ নয়। শুধু অস্ত্র তৈরির গবেষণায় যুক্ত থাকা তাদের সরাসরি লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারী বানায় না।”
হাসপাতাল বা মিডিয়া সংস্থার ওপর হামলা কী বৈধ?
উভয় পক্ষই একে অপরের হাসপাতালের ওপর হামলা করার অভিযোগের জন্য সমালোচিত হচ্ছে।
ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইসরায়েলের দক্ষিণ বিরশেবা শহরের সোরোকা মেডিকেল সেন্টারে বৃহস্পতিবার প্রায় ৭০ জন আহত হন।
ইসরায়েল এই হামলাকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও, ইরান দাবি করে হাসপাতালটি একটি সামরিক স্থাপনার কাছাকাছি ছিল, যা প্রকৃত লক্ষ্য ছিল না।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেন, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সোরোকা হাসপাতালের কাছে অবস্থিত একটি সামরিক ও গোয়েন্দা কেন্দ্রে আঘাত হেনেছে এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মাত্র একটি ক্ষুদ্র অংশে সামান্য ক্ষতি হয়েছে।
অন্যদিকে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজা অঞ্চলে ইসরায়েলের হামলার পর থেকে গাজায় অধিকাংশ হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্র ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইসরায়েল বলেছে, হামাস এসব স্থাপনা নিজেদের কার্যক্রমের আড়ালে ব্যবহার করছে।
তবে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় হাসপাতাল ও চিকিৎসা সুবিধাগুলোর ওপর হামলা নিষিদ্ধ।
আন্তর্জাতিক কমিটি অব দ্য রেড ক্রস আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী আইনের উল্লেখ করে বলেছে, আইএইচএল অনুসারে, হাসপাতাল এবং অন্যান্য চিকিৎসা সুবিধাগুলো, যদিও সেগুলো নাগরিক বা সামরিক; বিশেষ সুরক্ষা পায়, যা অন্যান্য নাগরিক স্থাপনার সাধারণ সুরক্ষার চেয়ে অনেক বেশি সুরক্ষা পায়। এই উন্নত সুরক্ষার উদ্দেশ্য হলো প্রয়োজনের সময় তারা কার্যকর থাকতে পারে। এই সুরক্ষা ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনের মাধ্যমে যুদ্ধের শিকারদের রক্ষার্থে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।”
ইসরায়েল সোমবার ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম আইআরআইবিকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়, যা সরাসরি সম্প্রচার বাধাগ্রস্ত করে।
টিভি অ্যাঙ্কর সাহার ইমামি ইসরায়েলের হামলাকে ‘দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন’ ও ‘সত্যের বিরুদ্ধে আঘাত বলে নিন্দা জানানার সময়ই একটি বিস্ফোরণ ঘটে এবং ধোঁয়া ও ধ্বংসাবশেষ স্ক্রীনে ভরে যায়। এরপর তার পালানোর ভিডিও দেখানো হয়, যেখানে একজন কণ্ঠ শোনা যায় ‘আল্লাহু আকবর’।
ইসরায়েল ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজার বিভিন্ন স্থানে দুই শতাধিক সাংবাদিক ও মিডিয়া কর্মীকে লক্ষ্য করে হত্যা করেছে। ২০২১ সালে গাজার একটি ভবন যেখানে আলজাজিরা ও দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের অফিস ছিল, তা ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংস হয়।
জেনেভা কনভেনশনের আওতায় সাংবাদিকদের জন্য আলাদা কোনো সুরক্ষা বিধান নেই, তবে ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব কম্পারেটিভ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ল’ বলেছে, “সাংবাদিকরা যুদ্ধকালীন সংঘাতে সাধারণ নাগরিকের মতোই সুরক্ষিত।”
LIMON
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: