আইএমএফের ঋণের দুই কিস্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত জুনে

প্রকাশিত: ১৭ এপ্রিল ২০২৫ ২৩:০৪ পিএম

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম সঠিক পথে আছে বলে মন্তব্য করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তবে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ কর্মসূচি থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ পাওয়ার বিষয়ে সংস্থাটির সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সমঝোতা হয়নি। আইএমএফ বলেছে, ঋণের বাকি দুই কিস্তির অর্থ জুনের দিকে ছাড় হতে পারে। এ বিষয়ে আলোচনা আরও চলবে। বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের আলোচনা শেষ হয়নি।

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে দুই সপ্তাহের পর্যালোচনা সফরের পর আইএমএফ প্রতিনিধি দল আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলে। এ ব্রিফিংয়ে আইএমএফের গবেষণা বিভাগের উন্নয়ন সামষ্টিক অর্থনীতি শাখার প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিওসহ ৯ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। প্রতিনিধি দলটি ৬ এপ্রিল থেকে গত বুধবার পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ বিভাগের পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি), জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এ প্রতিনিধি দল দুই দফা বৈঠক করেছে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গেও।

মিশনপ্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, ঋণ কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠেয় আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে এ বিষয়ে আরও আলোচনা হবে। এ বৈঠক হবে ২১ থেকে ২৬ এপ্রিল। এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে বাংলাদেশ ও এর জনগণের পাশে থাকার জন্য আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করছি।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, আইএফএফ মিশনের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা শেষ হয়নি। আগামী সপ্তাহে শুরু হওয়া সংস্থাটির বসন্তকালীন বৈঠকে বাংলাদেশের পরবর্তী কিস্তি ছাড় নিয়ে আলোচনা হবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ও ডেপুটি গভর্নর ড. হাবিবুর রহমানসহ একটি প্রতিনিধি দল যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছে। সেখানে সংস্থাটির উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক হবে। মূলত, বাংলাদেশের বিনিময়হার, রাজস্ব নীতি ও মুদ্রানীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে দ্বিমত রয়েছে। উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে, বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় নেওয়া বিভিন্ন নীতি তুলে ধরা হবে। এরপর উভয় পক্ষের ঐকমত্যের ভিত্তিতে স্টাফ পর্যায়ের চুক্তি সই হবে। সে আলোকে আগামী জুনের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে পরবর্তী দুই কিস্তি অনুমোদিত হতে পারে।

পাপাজর্জিও মনে করেন, বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে। যার ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে গেছে, যা এক বছর আগে একই সময়ে ছিল ৫ দশমিক ১ শতাংশ। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি এক দশকের সর্বোচ্চ ১১.৭ শতাংশে পৌঁছেছিল, যা ২০২৫ সালের মার্চ মাসে ৯.৪ শতাংশে নামে। তবে এ মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫-৬ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।

জুলাই বিপ্লব, কঠোর নীতি এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা দুর্বল হওয়ার কারণে এই মন্দা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছে আইএমএফ। পাপাজর্জিও মনে করেন, বাংলাদেশের রিজার্ভের পাশাপাশি বিনিময় হারও স্থিতিশীল। রিজার্ভের পরিমাণ এমনকি তাদের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার আরও নমনীয় হলে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বাড়বে। এ ছাড়া অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার জন্য রাজস্ব একত্রীকরণ, উন্নত কর সম্মতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের সুপারিশ করেছেন তিনি।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা সব সময় বিনিময়হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করার কথা বলে থাকি। তবে বাংলাদেশকে এখনই পুরো বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি তেমন না। স্বল্প মেয়াদে বিনিময়হার বাজারভিত্তিক করার একটা ভালো সময় যাচ্ছে। কেননা, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল আছে। আগে নিয়মিতভাবে যা কমছিল। আবার ব্যাংক এবং খোলাবাজারে ডলারের দরে ব্যবধান অনেক কম। এ সময়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা আয় ব্যাপক বাড়ছে।

তিনি আরও বলেন, ‘অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সুসংগঠিত ও বিস্তৃত আর্থিক খাত সংস্কার প্রয়োজন। এর জন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী আইনি সংস্কার জরুরি এবং দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে একটি কার্যকর কাঠামো বাস্তবায়ন করা দরকার—যা একদিকে ছোট আমানতকারীদের সুরক্ষা দেবে, অন্যদিকে সুশৃঙ্খলভাবে ব্যাংক পুনর্গঠন সম্ভব করবে।’

তিনি জানান, কার্যকর অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি জোরদার করবে। পাশাপাশি, আর্থিক খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং এর সার্বিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে উন্নত সুশাসন ও স্বচ্ছতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক খাত সংস্কার কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা ও শাসনব্যবস্থা জোরদারে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেছে আইএমএফ।

সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, চলমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাঠামোগত সংস্কারের গতি ধরে রাখা অত্যন্ত জরুরি। তাদের মতে, সুশাসন ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিনিয়োগের জন্য আরও অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে, যা প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বৃদ্ধির পাশাপাশি তৈরি পোশাক খাত ছাড়াও অন্যান্য খাতে রপ্তানি সম্প্রসারণে সহায়ক হবে।

আইএমএফের মতে, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে (এএমএল/সিএফটি) ঝুঁকি মূল্যায়নে অগ্রগতি এবং তথ্যের মানোন্নয়নও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

আইএমএফের সঙ্গে ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে পাওয়া গেছে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০২৪ সালের জুনে পাওয়া গেছে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার। বিপত্তি দেখা দেয় চতুর্থ কিস্তির অর্থছাড়ের বেলায়। অন্তর্বর্তী সরকারের আশা চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ একসঙ্গে পাওয়া যাবে আগামী জুনে।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর