আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্পর্ক বাড়াচ্ছে জামায়াত

নিউজ ডেস্ক প্রকাশিত: ০৩ অক্টোবর ২০২৫ ০৯:১০ এএম

আওয়ামী সরকারের রোষানলে পড়ে গত ১৫ বছর চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল জামায়াতে ইসলামী। ফ্যাসিবাদের দমননীতিতে স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্ন হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও একচেটিয়া অপপ্রচারের শিকার হয় দলটি। জুলাই বিপ্লবে স্বৈরাচার পতনের মধ্য দিয়ে দলটির পুনর্জাগরণ ঘটে। দেশ ফ্যাসিবাদমুক্ত হওয়ার পর দলটির কার্যক্রম জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দ্রুতই আলোচনায় চলে আসে। এমনকি আগামী জাতীয় নির্বাচনে জনরায় পেলে সরকার

এমন প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুনরায় সম্পর্ক জোরদার করছে জামায়াত। এর অংশ হিসেবে ঢাকায় নিয়োজিত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে একের পর এক মতবিনিময় করছেন দলের নেতারা। তারা বিভিন্ন দূতাবাস-সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন। এছাড়া বিভিন্ন দেশ সফর করে দলীয় অবস্থান, কর্মকাণ্ড, নীতি-কৌশল এবং আওয়ামী আমলে তাদের ওপর যেসব নির্যাতন করা হয়েছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরছেন।

সম্প্রতি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী সরকারের পতনের দিন থেকেই জামায়াতের কেন্দ্রীয় ও সারা দেশের কার্যালয়গুলো খোলা হয়। তবে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সংস্কারকাজ শেষে নতুনরূপে চালু হয় সেপ্টেম্বরে। এরপরই কার্যালয়টিতে বিদেশি দূতাবাস-সংশ্লিষ্টদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর সেখানে জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান প্রথম সাক্ষাৎ ও বৈঠক করেন চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের সঙ্গে। পরবর্তীতে একের পর কূটনীতিকদের আগমন ঘটে জামায়াত কার্যালয়ে।

এছাড়া দূতাবাস, মিশন ও কূটনীতিকদের বাসভবনে গিয়েও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন জামায়াত নেতারা। যোগ দিচ্ছেন বিভিন্ন দেশের অনুষ্ঠানে। এমনকি সংশ্লিষ্টদের আমন্ত্রণে বিভিন্ন দেশ সফর করছেন জামায়াত আমিরসহ দলের শীর্ষ নেতারা।

দলীয় একটি সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, পাকিস্তান, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ, কানাডা, ফ্রান্স, তুরস্ক, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, ব্রাজিলসহ ৪০টির বেশি দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে জামায়াত নেতাদের একাধিক বৈঠক হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ভারতীয় দূতাবাস বা দেশটির কোনো প্রতিনিধিদলের সঙ্গে জামায়াতের আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়নি।

সর্বশেষ গত বুধবার জামায়াত আমিরের সঙ্গে তার বসুন্ধরা কার্যালয়ে আলাদা সৌজন্য সাক্ষাৎ ও বৈঠক করেন ব্রাজিল ও সুইডেনের রাষ্ট্রদূত। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে আরো প্রায় ১৪ দেশের কূটনীতিক বা প্রতিনিধিদলের সঙ্গে জামায়াত নেতাদের বৈঠক হয়েছে। চলতি মাসের ১৬ তারিখ পর্যন্ত বেশকিছু দেশের কূটনীতিকের সঙ্গে বৈঠকের শিডিউল রয়েছে।

এছাড়া চলতি মাসের শেষদিকে আমেরিকা ও কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত আমিরসহ একটি প্রতিনিধিদল। পর্যায়ক্রমে বিদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরো জোরদার করার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির।

কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে কোন ধরনের বিষয় গুরুত্ব পায় জানতে চাইলে দলের একজন নেতা আমার দেশকে জানান, কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে জামায়াতের নীতি-কৌশল, রাজনৈতিক অবস্থান, দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনা এবং সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে দলের সম্পর্ক তৈরিসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। এসব বৈঠকে দলের নারী নেতাদেরও রাখা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জামায়াতের সম্পর্ক জোরদার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির আমির এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ-সংশ্লিষ্ট কমিটির প্রধান ডা. শফিকুর রহমান আমার দেশকে বলেন, আমরা সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চাই। আমরা সম্মান ও সমতার ভিত্তিতে চলতে চাই।

এ প্রসঙ্গে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ-সংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, আওয়ামী আমলে একটানা ১৪ বছর জামায়াতের কেন্দ্রীয় অফিস ছিল বন্ধ। এ সময় আমরা স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে পারিনি। আমাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের ভয়াবহ স্টিমরোলার চালানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও আমরা আমাদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারিনি। জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়।

জামায়াতের এই নেতা আরো বলেন, দলের কেন্দ্রীয় অফিস ঠিক করতে বেশ কিছুদিন সময় লেগে যায়। এরপর আমরা বিভিন্ন দূতাবাসে দাওয়াত দিই। তারা যাতে আমাদের অফিসে আসেন, আমাদের সম্পর্কে জানতে পারেন-এ জন্য। এরই অংশ হিসেবে অনেক কূটনীতিক আমাদের অফিসে এসেছেন, আমরাও তাদের অফিসে গিয়েছি। এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ দেশের কূটনীতিকের সঙ্গে আমাদের মতবিনিময় হয়েছে। কেউ কেউ একাধিকবার আমাদের অফিসে এসেছেন। ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত আরো কিছু দেশের কূটনীতিকের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।

কূটনীতিকদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানতে চাইলে জামায়াতের এই নেতা বলেন, বিভিন্ন আলোচনায় কূটনীতিকরা স্বাভাবিকভাবেই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচন, সংস্কার কার্যক্রম, আন্তর্জাতিক অবস্থান সম্পর্কে জানতে চান। এসব বিষয়ে আমরা আলোচনা করি। দেশে নতুন নতুন ইস্যুর উদ্ভব হচ্ছে, এসব বিষয়ে বিদেশি প্রতিনিধিদের অনেকে জানতে চাচ্ছেন। বিদেশ থেকেও বিভিন্ন প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ আসছে। তাদের সঙ্গেও আমাদের মতবিনিময় হচ্ছে। এ সময় আমাদের নীতি-পন্থাগুলো বিদেশিরা জানতে চান। বিশেষ করে নারী, জেন্ডার, সংখ্যালঘু, জঙ্গি ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের অবস্থান কী, আমাদের দলে নারী ফোরাম আছে কি না-এসব বিষয়ে তারা জানতে চান। সে মতে আমরা আমাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে থাকি। আমাদের নারী নেতারা অনেক যোগ্য। এতে তারা খুব সন্তুষ্ট। বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগের এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে।

জামায়াত সূত্রে জানা যায়, জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী চীন সরকার ও ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে জামায়াত প্রতিনিধিরা দুই দফায় দেশটি সফর করেছেন। সে সময় দেশটির বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম পরিদর্শনসহ নানা বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। বিদেশে জামায়াতের সবচেয়ে বড় সফর ছিল চলতি বছরের এপ্রিলে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আমন্ত্রণে ব্রাসেলসসহ কয়েকটি দেশ সফর করেন জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান, নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহেরসহ দলের অন্যান্য প্রতিনিধি। এ সময় দলের আমির যুক্তরাজ্য সফর করেন। ওইসব সফরে বাংলাদেশ নিয়ে জামায়াতের বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা ও সম্ভাবনাসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। বাংলাদেশে সফরে আসা ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিনিধিদলের সঙ্গেও একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার নেতাদের সঙ্গেও দলের নেতাদের মতবিনিময় অব্যাহত রয়েছে।

দলীয় সূত্রে আরো জানা যায়, কানাডা ও আমেরিকা সফরের সময় ইউরোপ সফরেরও সম্ভাবনা রয়েছে জামায়াত আমিরের।

সূত্রমতে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্পর্ক রক্ষা, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগসহ জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে একটি কমিটি কাজ করে। এই কমিটির সেক্রেটারি হিসেবে আছেন দলের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। এতে দলের শীর্ষ আরো অন্তত ১০ নেতা আছেন। এছাড়া দলের বাইরে বিশেষজ্ঞ হিসেবে জামায়াত আমিরের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহমুদুল হাসান।

এক প্রশ্নের জবাবে জামায়াত নেতা এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, আমরা ভারতসহ সব দেশের প্রতিনিধিকে আমাদের অফিসে দাওয়াত দিয়েছি। তবে এ পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে আমাদের কোনো মিটিং হয়নি, তারা আমাদের অফিসেও আসেনি। অন্যান্য দেশও এ বিষয়ে আমাদের কাছে জানতে চায় আমরা ভারতে কেন যাই না ইত্যাদি। আমরা বলেছি, ভারত যদি দাওয়াত দেয়, আমরা বিবেচনা করব। সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশী দেশ ভারত। তাদেরও আমাদের দেশ ও জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে।

আগামী দিনে ক্ষমতার রাজনীতিতে জামায়াতের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে দলের এই নেতা বলেন, বিগত সরকারের সময়ে দীর্ঘদিন আমরা স্বাভাবিকভাবে মানুষের পাশে যাওয়ার সুযোগ পাইনি। আমরা বিপদে-আপদে সীমিত সামর্থ্য নিয়ে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করছি। তবে জুলাই বিপ্লব এক বিরাট সুযোগ নিয়ে এসেছে। আমরা আমাদের কার্যক্রম আরো জোরদার করেছি। দুর্যোগের সময় জামায়াত আমিরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা সবার আগে হাজির হন। আমরা ইতিবাচক রাজনীতির ধারা আনার চেষ্টা করছি। আমাদের সামগ্রিক নীতি ও ভূমিকা দেখে সবাই সন্তুষ্ট। আগামী নির্বাচনে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে ইনশাআল্লাহ্।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, বিদেশে জামায়াতের কোনো শাখা নেই। শুধু দুটি দেশে দলটির মুখপাত্র আছেন। তারা হলেন ইউরোপে ব্যারিস্টার আবু বকর মোল্লা ও আমেরিকায় ড. নাকীবুর রহমান। তবে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত দলের শুভাকাঙ্ক্ষী ও সাবেক নেতাকর্মীরা স্থানীয় কমিউনিটিতে নানা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর