জুলাই বিপ্লবে নারী শহীদ

জানালার সামনে দাঁড়াতেই গুলি এসে লাগে মেহেরুনের শরীরে

প্রকাশিত: ০৯ এপ্রিল ২০২৫ ১০:০৪ এএম

‘পুরুষ মানুষ আমি। আমি তো কাঁদতে পারি না। বুক ফেটে যায়। আমি শুধু অপেক্ষায় আছি ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য। কবে মরব, কবে ওর সঙ্গে দেখা হবে। ওতো শুধু আমার মেয়ে ছিল না, ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে নেয়ামত। তাকে হারাইয়া ফালাইছি। এ কষ্ট আমি কারে বোঝাই। আপনারা সাংবাদিকরা ফোন করেন, আর এর মধ্য দিয়ে আমার মেয়ের কথা আরো বেশি মনে করাইয়া দেন।’

এভাবেই নিজের কষ্টের কথাগুলো তুলে ধরেছিলেন জুলাই বিপ্লবে শহীদ মেহেরুন নেছা তানহার বাবা মো. মোশাররফ হোসেন।

চব্বিশের জুলাই বিপ্লবে আন্দোলন করতে গিয়ে নির্মম নির্যাতনে নিহত হন মামাতো ভাই রাব্বি। ভাইয়ের হত্যার প্রতিবাদে মাঠে নামে মেহেরুন। শুধু ভাই হত্যার জন্যই নয়, সে দিন তার প্রতিবাদ হয়ে ওঠে দেশের আপামর জনগণেরই অভিব্যক্তি। ১৫ বছরের জমে থাকা ক্ষোভ, শোষণ-শাসন ও অনিয়মের বিরুদ্ধে মানুষের কণ্ঠগুলো যেন একযোগে প্রতিবাদী হয়ে উঠছে। এ দিকে আন্দোলন শেষ করে বাসায় ফেরেন মেহেরুন। কিন্তু তার সেই ফেরা স্থায়ী হয়নি। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী, বেপরোয়া র‌্যাব-পুলিশের গুলিতে রাজধানীর নতুনবাজারে ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় শহীদ হন মেহেরুন।

জুলাইয়ে ফ্যাসিস্টদের বর্বর হত্যাকাণ্ড দেখে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন মেহেরুন। মামাতো ভাই রাব্বিকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে পুলিশের হত্যার ঘটনা, গণহত্যা, ছাত্রদের গ্রেপ্তার, ব্লক রেইড দিয়ে ছাত্রদের ধরে নিয়ে নির্যাতনসহ নানা অন্যায়ের প্রতিবাদে রাজপথে প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন মেহেরুন। জীবন বাজি রেখেই রাস্তায় নেমেছিলেন।

মেহেরুন নেছা তানহার বয়স ছিল ২২ বছর। বাসা ছিল মিরপুরে। পড়তেন মিরপুরের হযরত শাহ আলী মহিলা কলেজের অনার্স (সম্মান) তৃতীয় বর্ষে। বাবা মোশাররফ হোসেন গাড়ি চালক, মা আছমা আক্তার গৃহিণী। পড়ালেখার পাশাপাশি পার্টটাইম কাজ করতেন। নিজের খরচ নিজেই বহন করতেন। তাদের গ্রামের বাড়ি ছিল মানিকগঞ্জের হরিরামপুর।

শুরুর দিকে মেহেরুন রাজপথে আন্দোলনে তেমন সম্পৃক্ত ছিলেন না। ১৯ জুলাই জুমার নামাজ পড়ে মিরপুর মাজার রোডে আন্দোলনে যোগ দেয় মামাতো ভাই রাব্বি। সেই মিছিলে পুলিশের গুলিতে মারা যায় রাব্বি। তার লাশ মেডিকেল মর্গে আটকে রেখেও ঝামেলা করে পরিবারের সঙ্গে। তিনদিন পর লাশ ফেরত দেওয়া হয়। সেই ক্ষোভ থেকেই রাস্তায় বেরিয়ে আসেন মেহেরুন ও তার ছোট ভাই তারিফ। মামাতো ভাই হত্যার বিচার চেয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে আন্দোলনে যোগ দেন মেহেরুন। তার হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে লেখা থাকত, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না।’

বাবা মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘কোনোভাবে তাদের ঘরে ধরে রাখতে পারতাম না। ওরা বলত। আমাদের ভাই শহীদ হয়েছে, আমরা ঘরে বসে থাকতে পারি না। আমাদের ভাই হত্যার বিচার চাইতে রাস্তায় নামতেই হবে। এ বলে প্রতিদিনই বের হতো।’

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে গেলে সারা দেশে উৎসুক জনতা আনন্দ মিছিল করে। মেহেরুন ও তার ছোট ভাইও বের হন মিছিলে যোগ দিতে। গণভবন ও সংসদ ভবন এলাকায় আনন্দ উদযাপন শেষে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় মেহেরুন বাসার দিকে রওয়ানা দেন। ছোট ভাই তখনো বাইরে থেকে যায়। বাসায় ফেরার পথে মিরপুর-১৩-এর নতুন বাজারের দিকে পুলিশের মুখোমুখি হন মেহেরুন। তখনো ওই দিকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ চলছিল ছাত্র-জনতার। সংঘর্ষের মধ্যেও মেহেরুন নিরাপদে বাসায় ঢুকেন।

বাসায় ফিরে নিজের কক্ষে ঢুকে ছোট ভাইকে কল করে মেহেরুন জানান, নতুনবাজারের দিকে সংঘর্ষ হচ্ছে, সে যেন অন্য রাস্তা দিয়ে বাসায় ফেরে। এর মধ্যে জানালার সামনে দাঁড়াতেই একটা গুলি এসে লাগে তার শরীরে। মুহূর্তে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই রাতে ১১টার দিকে জানাজা শেষে মিরপুরের পূর্ববাইশটেক কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়।

বাবা মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘মেয়েকে নিয়ে কত আশা ছিল। আমার বুকটা হাহাকার করছে। আমি কাউরে বোঝাতে পারি না। আমার মেয়েকে পুলিশ হত্যা করেছে শেখ হাসিনার নির্দেশে। শেখ হাসিনা কত মায়ের কত বাবার বুক খালি করে দিল। আমি তার বিচার চাই।’

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর