৪৯০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্রে উৎপাদন মাত্র ৩০ মেগাওয়াট

প্রকাশিত: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:০২ এএম

হবিগঞ্জের শাহজিবাজার বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৪৯০ মেগাওয়াটসম্পন্ন তিনটি প্ল্যান্টের একটি কোনোরকমে চলছে, যা থেকে মাত্র ৩০ মেগাওয়াট (৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন) বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। বাকি দুটির মধ্যে ১০০ মেগাওয়াটের প্ল্যান্টটি উদ্বোধনের পর ৪ বছরে মাত্র ৬৭ দিন চলেছে।

সবচেয়ে বড় ৩৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্ল্যান্টটি ২০২২ সালে আগুন লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু কারসাজি করে এটি মেরামতে কালক্ষেপণ করা হয়েছে। ফলে এখনো এটি উৎপাদনে যেতে পারেনি। এ কারণে এ দুটি প্ল্যান্টে ৪ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ থেকে বঞ্চিত হয়েছে দেশের মানুষ। এর পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র ছিল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, ২০১৬ সাল থেকে উৎপাদনে থাকা ৩৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্ল্যান্টটিতে ২০২২ সালের ২৯ মে আগুন লাগে। এর ৩টি ট্রান্সফরমারসহ বেশকিছু যন্ত্রাংশ পুড়ে যায়, যা মেরামতের জন্য তৎকালীন জ্বালানি সচিবের নির্দেশে সেই বছরের আগস্টেই প্রস্তাবনা পাঠানো হয়, বোর্ড সম্মতিও দেয়। যা বাস্তবায়ন হলে তিন মাসেই উৎপাদনে ফেরানো যেত প্ল্যান্টটি। কিন্তু অদৃশ্য কারণে কালক্ষেপণ করা হয়।

সেই ক্রয়প্রক্রিয়া বাতিল করে প্রায় ১৫ মাস পর আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। সে প্রক্রিয়ায় যায় আরও ৯ মাস। সবশেষ ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বাংলাদেশি একটি কোম্পানির সঙ্গে ৮ মাসে একটি ইউনিট সংস্কারের চুক্তি হয়। যে কারণে প্রায় ২৪ মাসেও উৎপাদনে যেতে পারেনি প্ল্যান্টটি। প্রস্তাব অনুযায়ী সংস্কার হলে তিন মাসেই উৎপাদন সম্ভব ছিল। সে হিসাবে বাকি ২১ মাসে কয়েক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ থেকে বঞ্চিত হয়েছে দেশ, যা রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট ও আমদানি মূল্যের সঙ্গে তুলনা করলে প্রতিদিন ৪ কোটি টাকার ক্ষতি। ২১ মাস হিসাবে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি।

এ বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বুধবার বলেন, বিগত সময়ে সরকারি প্ল্যান্টগুলো চালু রাখার বিষয়ে নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে। এ ষড়যন্ত্র করে তারা কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ কিনেছে। তাতে তারা কীভাবে লাভবান হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্ল্যান্ট রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তহবিল গঠন করা হয়েছিল; কিন্তু তা বরাদ্দ দিতে নানা টালবাহনা ছিল। মূলত বেসরকারি প্ল্যান্টকে সুবিধা দিতেই সরকারি প্ল্যান্টগুলো বন্ধ রাখার চেষ্টা ছিল। সরকারের ভেতর ও বাইরের লোকজন মিলেই এই ষড়যন্ত্র করেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, এ ক্ষতির দায় সাবেক সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের। বোর্ড সুপারিশ করলেও তিনি চাননি বলেই দ্রুত সংস্কার হয়নি।

কেন্দ্রটির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা আশা করছি, এপ্রিলেই একটি ইউনিট চালু করতে পারব। তাতে ১১০ মেগাওয়াট উৎপাদন সম্ভব হবে। বাকি ২২০ মেগাওয়াট বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দ্রুত সেই দুটি ইউনিটও সংস্কারের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে কবে নাগাদ সচল হবে, তা তিনি বলতে পারেননি।

অন্যদিকে ৮৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত ১০০ মেগাওয়াট প্ল্যান্টটি পরীক্ষামূলক চালু হয় ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু বারবার যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ায় সবশেষ বন্ধ হয় ২০২৪ সালের ২০ এপ্রিল। ৪ বছরে প্ল্যান্টটি চলেছে মাত্র ১৬১০ ঘণ্টা বা ৬৭ দিন। শুধু পুরোনো মেয়াদ উত্তীর্ণ একটি ৬০ মেগাওয়াটের প্ল্যান্ট বর্তমানে চালু আছে, যা থেকে মাত্র ৩০ মেগাওয়াট উৎপাদন হচ্ছে।

এ প্রকল্পের পরিচালক একে মফিজউদ্দিন আহমেদ জানান, বারবার যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কেবল করপোরেশনের কাছ থেকে এখনো প্ল্যান্টটি বুঝে নেওয়া হয়নি। তাদের বলা হয়েছে যেসব যন্ত্রপাতিতে সমস্যা রয়েছে তা পরিবর্তন করে দিতে। এ নিয়ে চিঠি চালাচালি হচ্ছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রাজি হয়েছে।

তিনি বলেন, ত্রুটির কারণে ক্যাপাসিটি টেস্ট সম্পন্ন হয়নি। তার হিসাবমতে, ৬৭ দিনে প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচ ৪ টাকা ১৭ পয়সা হিসাবে প্রায় ৬৪ কোটি টাকার বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়েছে। সেই হিসাবে সঠিকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ৪ বছরের বাকি ১৪০০ দিনে সরকারি উৎপাদন খরচ হিসাবে ১৪০০ কোটি টাকার বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হতো, যা থেকে বঞ্চিত দেশের মানুষ।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বুধবার রাতে বলেন, অতীতে যেসব কর্মকাণ্ড হয়েছে, এর কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। তবে এসব প্ল্যান্ট কীভাবে দ্রুত উৎপাদনে আনা যায়, সেই চেষ্টা চলছে।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর