হাসিনা আমলে প্রশাসনে পদোন্নতিবঞ্চিত
পুনর্বিবেচনার তালিকায় আরও ৭৭৬ জন
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার শাসনামলে পদোন্নতিবঞ্চিত প্রশাসনের আরও ৭৭৬ জন কর্মকর্তার ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির আবেদন পুনর্বিবেচনা করবে সরকার। এ লক্ষ্যে সাবেক অর্থ সচিব ও বিশ্বব্যাংকের বিকল্প পরিচালক জাকির আহমেদ খানের নেতৃত্বে গঠিত ৫ সদস্যের রিভিউ কমিটির মেয়াদ আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এছাড়া রিভিউ কমিটির সুপারিশ থেকে বঞ্চিত অবসরে যাওয়া প্রশাসন ছাড়া অন্য ক্যাডার (আদার্স ক্যাডার) কর্মকর্তাদের আবেদন বিবেচনা করা হবে। যদিও এর আগে ৭৬৪ জনকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়ার সময় কোনো কারণ ছাড়াই তাদের বিবেচনায় আনা হয়নি। শুধু প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল।
এদিকে রিভিউ কমিটির সুপারিশ নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিযোগ-ভূতাপেক্ষ পদোন্নতিপ্রাপ্তদের জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হয়নি। এছাড়া রিভিউর জন্য আবেদন না করা, স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেওয়া, বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করা কর্মকর্তা এবং দুদক মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামিকেও ওই কমিটি সুপারিশ করেছিল। আর এই সুপারিশের আলোকেই ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
উল্লেখ্য, প্রয়োজনীয় সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিগত ফ্যাসিবাদের আমলে বিভিন্ন স্তরের বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন। এরই মধ্যে তারা অবসরেও চলে গেছেন। বঞ্চনার শিকার এসব কর্মকর্তার বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য বর্তমান সরকার উচ্চ পর্যায়ের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। কমিটির সভাপতি সাবেক অর্থ সচিব ও বিশ্বব্যাংকের বিকল্প পরিচালক জাকির আহমেদ খান এবং সদস্য সচিব জনপ্রশাসন সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান। গত বছর ১৬ সেপ্টেম্বর ওই কমিটি গঠন করা হয়। ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে বঞ্চিত হয়ে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের আবেদন পর্যালোচনা করে সুপারিশ করে কমিটি। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে গত ১০ ডিসেম্বর ৭৬৪ জনকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি প্রদান করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ভূতাপেক্ষ পদোন্নতিবঞ্চিত হয় ৭৭৬ কর্মকর্তা। তারা সবাই পদোন্নতির জন্য পুনরায় আবেদন করেন।
এর মধ্যে বিভিন্ন ব্যাচের চার শতাধিক অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব রয়েছেন। আবেদনে তারা একদিকে যেমন পদোন্নতির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন, অপরদিকে তারা গত ডিসেম্বর মাসে দেওয়া ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির বেশ কিছু অনিয়ম ও অসঙ্গতি উল্লেখ করেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তাদের আবেদন পুনর্বিবেচনার আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, পর্যালোচনা কমিটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে এবং সরকার তাদের আবেদন ইতিবাচকভাবে দেখবে। জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে মন্ত্রণালয়ের এপিডি অনুবিভাগের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুনরায় করা আবেদন পুনর্বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা হবে। পুনর্বিবেচনার জন্য কোনো আবেদন আহ্বান করবে না জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। শুধু স্বেচ্ছায় যারা আবেদন করবেন, কেবল তাদের আবেদন কমিটিতে উপস্থাপন করা হবে।
এছাড়া বিভিন্ন ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতিবঞ্চিত অতিরিক্ত সচিব ফোরামের নেতারা জনপ্রশাসন সচিবের কাছে করা আবেদনে উল্লেখ করেন-অনেক বঞ্চিত কর্মকর্তা রিভিউর আবেদন করেছেন কিন্তু তাদের আবেদন ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির জন্য বিবেচনা করা হয়নি। অপরদিকে রিভিউ কমিটিতে আবেদনই করেননি-এমন কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তারা উদাহরণ দিয়ে বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের ১০ম ব্যাচের কবিরুল ইয়াজদানি খানকে গ্রেড-১ পদে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি রিভিউ কমিটিতে পদোন্নতির জন্য আবেদনই করেননি। যে তারিখ থেকে তাকে অতিরিক্ত সচিব পদে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, সে তারিখে তিনি অতিরিক্ত সচিব হওয়ার যোগ্যতাই অর্জন করেননি। একই ব্যাচের কর্মকর্তা আহসানুল হক স্বেচ্ছায় অবসরে গেছেন। অথচ তিনি বঞ্চিত হিসাবে আবেদন করেছেন এবং ভূতাপেক্ষ যুগ্মসচিব হিসাবে পদোন্নতি পেয়েছেন। বঞ্চিতদের প্রশ্ন স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়া কারও কি পদোন্নতি পাওয়ার সুযোগ আছে? কোথায় আছে তা কমিটিকে স্পষ্ট করতে হবে।
ওই আবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, একাধিকবার পদোন্নতিবঞ্চিত ১৯৮২ (বিশেষ) ব্যাচের নুসরাত জামান বিগত স্বৈরাচার আমলের অধিকাংশ সময় ওএসডি ছিলেন। চাকরিজীবনের শেষপ্রান্তে এসে পদোন্নতি পেলেও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকার তাকে পোস্টিং দেয়নি। এবারও তিনি ভূতাপেক্ষ পদোন্নতিবঞ্চিত। অথচ একই ব্যাচের অতিরিক্ত সচিব আতাউর রহমান এনডিসিকে সচিব হিসাবে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি কখনোই পদোন্নতিবঞ্চিত ছিলেন না।
পদোন্নতিবঞ্চিত অতিরিক্ত সচিব ফোরামের ওই আবেদনে আরও বলা হয়, ১৯৮৪ ব্যাচের খালেদা পারভীন এবং রিয়াজ আহমেদ উপসচিব, যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে নিয়মিত পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তা। এবার বঞ্চিত হিসাবে তারা গ্রেড-১ পদে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পেয়েছেন। কখনোই বঞ্চিত না হয়েও সচিব হিসাবে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পেয়েছেন সুষেন চন্দ্র দাস। একই ব্যাচের জসিম উদ্দিন মাহমুদকে যুগ্মসচিব হিসাবে পদোন্নতি না দিয়ে সরাসরি অতিরিক্ত সচিব হিসাবে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। একই ব্যাচের আবুয়াল হোসেন উপসচিব, যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিব হিসাবে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৯ বার পদোন্নতিবঞ্চিত। তিনি ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হননি।
এছাড়া ১৯৮৫ ব্যাচের ফুয়াদ হোসেন চাকরিজীবনে একবারও পদোন্নতিবঞ্চিত হননি। পক্ষান্তরে ডক্টর আশরাফুল ইসলাম ৯ বার পদোন্নতিবঞ্চিত। ফুয়াদ হোসেন সচিব হিসাবে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পেলেও ডক্টর আশরাফুল ইসলামের আবেদন বিবেচনা করা হয়নি। একই ব্যাচের সম্মিলিত মেধা তালিকায় ২৮তম মো. আমিনুল ইসলাম উপসচিব, যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে একাধিবার পদোন্নতিবঞ্চিত। বঞ্চনা নিরসন কমিটি তাকে গ্রেড-১ হিসাবে পদোন্নতি দিয়েছে। কিন্তু একই ব্যাচের মেধা তালিকায় পেছনের দিকে অবস্থান করা সুলতান আহমেদ ও খলিলুর রহমানকে সচিব হিসাবে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিয়েছে। বঞ্চিতদের প্রশ্ন তাহলে মেধার মূল্যায়ন কি শুধুই কথায়?
আবেদনে আরও বলা হয়, ১৯৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ বেগম ও অন্যান্য ব্যাচের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। অথচ তাদের সচিব বা অতিরিক্ত সচিব হিসাবে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। জানতে চাইলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মমতাজ বেগম বলেন, আমি এখন ব্যস্ত। পরে ফোনে কথা বলেন। এরপর তার সেলফোনে একাধিবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
এ বিষয়ে সাবেক এপিডি ও বর্তমান শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ওবায়দুর রহমান (এপিডির দায়িত্বে থাকাকালে) বলেন, অবসরে যাওয়ার পর কে নাগরিকত্ব গ্রহণ করল আর কে করল না তা দেখার সুযোগ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নেই। সরকার তাদের বঞ্চিত কর্মকর্তা হিসাবে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিয়েছে। এ বিষয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করা কাউকে সচিব হিসাবে পদোন্নতি বা চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া মস্ত বড় অপরাধ। এটা হতেই পারে না। আইন না জেনে বেআইনি আদেশ জারির কোনো সুযোগ নেই।
এদিকে যে ৭৬৪ জনকে উপসচিব থেকে সচিব পদ পর্যন্ত ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে তারাও নানা ধরনের অভিযোগ করছেন রিভিউ কমিটি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এডিপি অনুবিভাগে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। তাদের অভিযোগ রিভিউ কমিটি-যে কর্মকর্তা যে তারিখ থেকে সিনিয়রিটি পাওয়ার কথা তা দেওয়া হয়নি। ইতোমধ্যে পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তা তাদের সিনিয়রিটি দাবি করে আবেদন করেছেন। তাদের কয়েকজন প্রায় অভিন্ন সুরে বলেন, ধরুন একজন কর্মকর্তা ২০১২ সালের ৩০ মার্চ যুগ্মসচিব, ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ থেকে অতিরিক্ত সচিব হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলেন। কিন্তু তাকে ওই তারিখে পদোন্নতিবঞ্চিত করেছে বিগত সরকার। ফলে তিনি বঞ্চিত। রিভিউ কমিটি ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করলেও তাকে ’১২ সাল থেকে সিনিয়রিটি দেওয়ার বিষয়ে কিছু বলেননি। ফলে সে আর্থিক সুবিধা অনেক কম পাবেন।
তারা আরও জানান, ১৯৮২-এর রেগুলার ব্যাচ ছাড়া সব ব্যাচের কর্মকর্তাদের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতিপ্রাপ্তদের সিনিয়রিটি কেড়ে নেওয়া হেেয়ছে। এছাড়া বঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত অন্য ক্যাডারের একাধিক সংগঠন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি বাতিলের দাবি জানিয়েছে। কারণ প্রশ্নবিদ্ধ এ ভূতাপেক্ষ পদোন্নতিতে শুধু প্রশাসন ক্যাডারের একাংশের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। আবার প্রশাসন ক্যাডারের বড় একটি অংশকে বাদও দেওয়া হয়েছে। তাদের অভিযোগ-শুধু একটি ক্যাডারের পদোন্নতি বিবেচনার জন্য কমিটি করা হয়নি। আর আদার্স ক্যাডারের বঞ্চিতদের আবেদন এখনো রিভিউ করা হয়নি। সুতরাং ওই পদোন্নতি বাতিল করতে হবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: