‘জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি: গণভোট ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন’

নিউজ ডেস্ক প্রকাশিত: ১৬ অক্টোবর ২০২৫ ২২:১০ পিএম

‘জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি: গণভোট ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনার বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) বিকেলে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ ইসলামিক ইউনিভার্সিটির সাবেক ভিসি প্রফেসর মো. কোরবান আলীর সভাপতিত্বে রাজধানীর ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সেমিনারে কী-নোট স্পিকার হিসেবে সেমিনারের বিষয়বস্তুর ওপর বক্তব্য উপস্থাপন করেন:

কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন। সেমিনারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জাতীয় নেতৃবৃন্দ, সাবেক সচিব, সাবেক ভিসি ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। বক্তারা জুলাই জাতীয় সনদ অন্তর্ভুক্ত করে নভেম্বরের মধ্যেই গণভোট সম্পন্ন করার দাবি জানান।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিমের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সেমিনারে আরও বক্তব্য রাখেন খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমীর মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন্দ, মাওলানা আবু তালেব, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মুফতি ফখরুল ইসলাম, সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. আবদুল লতিফ মাছুম, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ফখরুল ইসলাম, সাংবাদিক মাসুমুর রহমান খলিলী,ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম, এডভোকেট শেখ আতিয়ার রহমান, ব্রিগেডিয়ার (অব.) মাহমুদুল হাসান, ঢাকা সিটি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর কাজী মিনহাজুল রহমান, প্রফেসর ডা. কর্ণেল (অব.) জেহাদ খান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলাম, সাবেক সচিব ড. মো. জাহেদুল ইসলাম প্রমুখ।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি ফরিদ আহমেদ বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে না পারলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যর্থ। জুলাইয়ে হাজার হাজার মানুষের রক্ত বৃথা যাবে। পিআর পদ্ধতির নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে স্বামী-স্ত্রী দুজন এমপি হওয়ার সুযোগ থাকবে না। অতীতে দেখা গেছে, মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে একই পরিবারের, একই ঘরের দুজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, এমপি বানানো হয়েছে। ফলশ্রুতিতে এই ব্যবস্থার নির্বাচনে স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। দেশের জনগণ এই ব্যবস্থার পরিবর্তন চায়।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন বিষয় সংসদ কিংবা আদালতে নেওয়ার কথা বলে ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার’ করার চেষ্টাকারী দল অবশেষে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির জন্য গণভোটের পক্ষে একমত হলেও গণভোটের সময় নিয়ে তারা টালবাহানা করছে। তারা জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট করতে চায়। জাতীয় নির্বাচন এবং গণভোট একই দিনে সম্ভব নয়, সুযোগও নেই। কারণ একজন ভোটার গণভোটের প্রস্তাবিত ব্যালট পড়ে বুঝে ভোট দিতে গেলে যে সময়ের প্রয়োজন, তাতে সব ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবে না। দেখা যাবে, ভোটাররা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু ভোট দিতে বেশি সময় লাগার কারণে অনেকে ভোট দিতে পারবে না। সংস্কার কমিশনের সকল সুপারিশ গণভোটে প্রস্তাব করে নভেম্বরের মধ্যে গণভোট সম্পন্ন করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, অবশ্যই আগামী সংসদ নির্বাচন জুলাই সনদের ভিত্তিতে ফেব্রুয়ারিতেই হতে হবে।

পিআর পদ্ধতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হচ্ছে পিআর পদ্ধতি। যারা বলে তারা পিআর বোঝে না, তারা রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা করে না। তিনি তাদের পিআর বিষয়ে অধ্যয়ন করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, পড়তে না পারলে লজ্জা না করে আমাদের কাছে আসুন, আমরা বুঝিয়ে দেব।

মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, একটি দলের পকেটে রাষ্ট্রকে ঢুকিয়ে দিতে কাজ করছেন কয়েকজন উপদেষ্টা। তারা ঐ দলের পছন্দ অনুযায়ী ডিসি-এসপি বদলি করে দলীয় লোকদের ঐসব পদে পদায়ন করছেন। এই পরিস্থিতিতে সংস্কারের কোনো মূল্য থাকে না, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে-এমন বিশ্বাস করা যায় না। প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনার উপদেষ্টা পরিষদের চার-পাঁচজন উপদেষ্টা একটি দলের প্রতি অনুগত। তারা ঐ দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে। এতে আপনার নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ। তাদের আপনি সতর্ক করুন, না হলে সরিয়ে নতুন উপদেষ্টা মনোনয়ন দিন।

আপনার প্রতিশ্রুতি ছিল সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন। সংস্কার ও বিচার ছাড়া নির্বাচনে জনমনে সংশয় তৈরি হয়েছে। জুলাই সনদে স্বাক্ষর করার আগে অমীমাংসিত ইস্যুগুলো মীমাংসা করতে হবে এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুস আহমাদ বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন না হলে শহীদদের রক্তের সঙ্গে গাদ্দারি করার শামিল হবে। জাতির স্বার্থে ও দেশের স্বার্থে জামায়াতে ইসলামীর উত্থাপিত পিআর পদ্ধতিসহ পাঁচ দফা দাবি মেনে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দেশ ও জাতির স্বার্থে যেকোনো দাবি আদায়ে ইসলামী আন্দোলন অতীতের মতো ভবিষ্যতেও রাজপথে নিঃস্বার্থ ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি ড. এ.এইচ.এম. হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার কাতারে এসে নেতৃত্ব দিতে না পারার ব্যর্থতা ঢাকতে একটি দল জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। এজন্য তারা একেকবার একেক ধরনের কথা বলে। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল গণহত্যার বিচার ও সংস্কারের ভিত্তিতে নির্বাচন করবে। কিন্তু সরকারের প্রতিশ্রুতির কোনো কিছুই দৃশ্যমান হয়নি। সরকার হাসিনার তৈরি সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আয়োজন করতে যাচ্ছে। সংস্কারের আইনি ভিত্তি দেওয়া না হলে জুলাই সনদ কেবলই এক টুকরো কাগজে পরিণত হবে। জুলাই সনদে নির্বাচনব্যবস্থা ও প্রক্রিয়ার বিষয়ে কিছুই রাখা হয়নি। ফলে পুরোনো ব্যবস্থায় আবারও ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটবে, জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না। যেই ব্যবস্থার নির্বাচনে বিগত ৫৪ বছরেও মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি, সেই ব্যবস্থার নির্বাচনে কখনোই মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না। তাই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিয়ে জনগণের সরকার গঠন ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সিনিয়র নায়েবে আমির আবদুল মাজেদ বলেন, ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানকে বারবার কাটাছেঁড়া করে স্বৈরাচার হাসিনা তার মতো করে তৈরি করেছে। সেই সংবিধান এখনো বহাল। হাসিনার বাপের আর হাসিনার তৈরি সংবিধান দিয়ে দেশ চলতে পারে না। কারণ এই সংবিধানে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। এই সংবিধানের অধীনে যারা দেশ পরিচালনা করবে তারাই ফ্যাসিবাদ কায়েম করবে। স্বৈরাচারের পথ চিরতরে বন্ধ করতে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিকল্প নেই।

জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সহসভাপতি ও মুখপাত্র ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ প্রধান বলেন, জুলাই সনদের বাস্তবায়নের উপায় স্পষ্ট না করেই সরকার জুলাই সনদে স্বাক্ষরের আয়োজন করতে যাচ্ছে। বাস্তবায়নের উপায় স্পষ্ট না করলে জুলাই সনদ মূল্যহীন এক টুকরো কাগজ হিসেবে থেকে যাবে। গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনে হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। জাতীয় নির্বাচনের দিন প্রত্যেক দল ও প্রার্থী নিজ নিজ দল নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। গণভোটের বিষয়ে সাধারণ জনগণের কাছে কোনো বার্তা যাবে না। ফলে সাধারণ ভোটার গণভোটে ভোট দিতে পারবে না। তাই জাতীয় নির্বাচনের দিনে নয়, নভেম্বরের মধ্যে গণভোট সম্পন্ন করতে তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেন, জুলাই সনদে পিআর পদ্ধতির প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জনগণ যদি পিআর না চায়, আমরা কখনো পিআরের দাবি তুলব না। কিন্তু জনগণ পিআর চাইলে কোনো দল না চাইলেও পিআর পদ্ধতিতেই নির্বাচন হতে হবে।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর