ইরানে যেভাবে ব্যর্থ হয়েছে ইসরায়েল:বিশ্লেষণ

নিউজ ডেস্ক প্রকাশিত: ২৬ জুন ২০২৫ ০০:০৬ এএম

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

টানা ১২ দিনের বোমা বর্ষণের পর ইরানে কী অর্জন করেছে ইসরায়েল? প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার সময় যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে তিনি বলেছেন, ইসরায়েলের লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। কিন্তু এমন দাবি নিঃসন্দেহে প্রশ্নবিদ্ধ, এটি অন্তত বলা যায়।

এই স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধের শুরুতেই নেতানিয়াহু দুটি লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করেছিলেন, ‘পারমাণবিক কর্মসূচিকে ধ্বংস করা’ এবং ‘শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো’। তাহলে প্রশ্ন হলো, পারমাণবিক কর্মসূচি কি ধ্বংস হয়েছে? উত্তর সম্ভবত না।

ধারণা করা হচ্ছে, ইরান ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনা থেকে বিভাজনযোগ্য পদার্থ সরিয়ে ফেলেছিল। এই ফোরদোতে যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করেছে। ফোরদোর মজুতই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির মূল উপাদান। ফলে ‘ধ্বংস’ করার লক্ষ্যটি ব্যর্থ হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়।

তাহলে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে আদৌ কোনো ক্ষতি করতে পেরেছে কি? এটাও অস্পষ্ট। নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করাতে পেরেছিলেন যেন তারা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর শক্তিশালী ‘বাঙ্কার-বাস্টার’ বোমা ফেলে। কিন্তু এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলি অভিযানকে খুব একটা সহায়তা করেনি। ঠিক কতটা ধ্বংস হয়েছে তা নির্ধারণ করাও কঠিন, কারণ ইরান বাইরের পর্যবেক্ষণকারীদের প্রবেশাধিকার দেবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়।

আর ইসরায়েল কি ইরানে ‘শাসন দর্শনের পরিবর্তন’ ঘটাতে পেরেছে? এর সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো, বরং উল্টোটা ঘটেছে। ইসরায়েল ইরানের বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যা করে একটি গণ-অভ্যুত্থান উস্কেকে দিতে চেয়েছিল।

এই কৌশলটি ইসরায়েলের একটি দৃঢ় বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়ানো। তাদের মতে, শত্রুপক্ষকে অস্থির করতে হলে তার শীর্ষ নেতাদের হত্যা করাই সবচেয়ে কার্যকর। কিন্তু ইতিহাস বলছে, এই কৌশল কখনোই সফল হয়নি। একমাত্র সম্ভাব্য ব্যতিক্রম ছিল হাসান নাসরাল্লাহর মৃত্যু এবং তার প্রভাব পড়ে হিজবুল্লাহর ওপর। তবে সেটির পেছনে ছিল লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতা। বাকি সবক্ষেত্রেই ইসরায়েলি হত্যাকাণ্ড কোনো বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছে।

ইরানের ক্ষেত্রে তাদের শীর্ষ সামরিক ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের হত্যাকাণ্ড জনগণকে সরকারের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করে তোলে। ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর (আইআরজিসি) শীর্ষ কমান্ডারদের হত্যা করে ইসরায়েল। যারা ছিলেন ইরানি রাজনীতিতে সম্ভবত সবচেয়ে ক্ষমতাধর, একই সঙ্গে জনগণের মধ্যে ঘৃণিত ছিলেন। তবু অনেক ইরানি, যারা নিজেদের ইসলামি প্রজাতন্ত্র এবং বিশেষ করে আইআরজিসির ঘোরতর বিরোধী বলে মনে করেন, তারাও শেষ পর্যন্ত এই বাহিনীর পক্ষেই দাঁড়ান। কারণ, ইরানিরা বুঝতে পারেন, এই হামলা শুধু ‘আদর্শগত শাসনের’ ওপর নয়, বরং গোটা ইরান রাষ্ট্রের ওপর।

ইসরায়েল তথাকথিত ‘শাসনের প্রতীকগুলো’ বোমাবর্ষণের মাধ্যমে ধ্বংস করতে চেয়েছিল এবং এতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। ইভিন কারাগার, ডুমসডে ক্লক, আইআরআইবিকে লক্ষ্য বানায় ইসরায়েল। ইভিন কারাগারে বিমান হামলা চালিয়ে ইসরায়েল বোঝাতে চেয়েছিল, তারা রাজনৈতিক বন্দিদের ওপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে ইরানি জনগণের সংগ্রামে সাহায্য করছে। বাস্তবে এসব হামলার ফলে বন্দিদের অবস্থা আরো সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। কারণ কর্তৃপক্ষ তাদের অনেককে অজানা স্থানে স্থানান্তর করে।

তেহরানে প্যালেস্টাইন স্কয়ারে রয়েছে ‘ইসরায়েল ডুমসডে ক্লক’ বা ‘ইসরায়েল ধ্বংসের ঘড়ি’। ইরানের সর্বোচ্চ নেতার ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, ইরান ২০৪০ সালের পর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ইসরায়েল তার জনগণকে বোঝায়, ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে অঙ্গীকারবদ্ধ ইরান। তাই ডুমসডে ক্লকেও হামলা চালিয়েছে নেতানিয়াহুর দেশ, যা হাস্যকর।

ইরানি রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার সংস্থা আইআরআইবির ওপর বোমাবর্ষণও ছিল অযৌক্তিক। ইসরায়েল দাবি করে, তারা সরকারের প্রচারযন্ত্রকে স্তব্ধ করতে চেয়েছে। কিন্তু বহু ইসরায়েলির মতে, এই হামলাই ইসরায়েলি টিভি চ্যানেলগুলো ধ্বংস করার যুক্তি তুলে দিয়েছে ইরানের হাতে। তাহলে ইসরায়েল যদি তাদের ঘোষিত লক্ষ্য অর্জন না-ই করে থাকে, তারা কি অন্তত বিশ্বকে নিজেদের পক্ষে একত্রিত করতে পেরেছে? গাজা প্রসঙ্গকে পেছনে ঠেলে দিয়ে আবার নিজেদের ‘ন্যায়ের যুদ্ধে লিপ্ত রাষ্ট্র’ হিসেবে উপস্থাপন করতে পেরেছে? উত্তর হলো, সম্ভবত না।

সত্য হলো, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা আন্তর্জাতিক আইনের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নীতি লঙ্ঘন করেছে। যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে। তবে ট্রাম্প সরাসরি ইসরায়েলের পাশে থেকে যুদ্ধে অংশ নেননি। হামলার পরই যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত বোমারু বিমানগুলো ফিরে গেছে।

এই হামলার আগে এবং পরে ট্রাম্প বারবার বলেছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে একটি চুক্তি চান; যেটিতে ইসরায়েলও থাকতে পারে। তাই ধারণা করা হচ্ছে, তিনি ইসরায়েলকে সহায়তা করেছেন মূলত নিজের স্বার্থ ও উপসাগরীয় মিত্রদের স্বার্থ রক্ষার জন্য।

বিশ্বের কিছু নেতা, বিশেষ করে জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস যদিও দ্রুত মার্কিন হামলা এবং ‘ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার’-এর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তবু কেউই ইসরায়েলের কঠোর শর্তাবলি গ্রহণ করেননি; যার মধ্যে ছিল ইরান একেবারেই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারবে না।

বিশ্ব সম্প্রদায় আবারও সেই পুরোনো অবস্থানে ফিরে গেছে, ‘পারমাণবিক অস্ত্র নয়’। এই বিষয়ের সঙ্গে ইরান আগেই একমত হয়েছিল।

মধ্যপ্রাচ্যে কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি এখন এমন যে, ইরানকে একটি বৈধ ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এটি ইসরায়েলের জন্য এক পরাজয়, আর ইরানের জন্য এক বিজয়।

ইসরায়েলের মূল ভূখণ্ডে যে বাস্তব ক্ষতি হয়েছে, সেটিও উপেক্ষা করা যাবে না। ইসরায়েল খুব দ্রুত ইরানের আকাশসীমায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় এবং ইচ্ছেমতো হামলা চালায়। কিন্তু ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র বারবার ইসরায়েলের সুপরিচিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’ ভেদ করে দেশজুড়ে আঘাত হানে, তাদের কেন্দ্রীয় অঞ্চলেও এবং তাতে পুরো দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। এতে উল্লেখযোগ্য হতাহতের পাশাপাশি ব্যাপক ধ্বংস সাধিত হয়।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ব্যবহৃত ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্র প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং তাৎক্ষণিকভাবে পুনরায় মজুত করার কোনো উপায় ছিল না। ইসরায়েলের অর্থনীতি দ্রুত স্থবির হয়ে পড়ে। এটিও ইরানের আরেকটি সাফল্য।

যদিও ইরান ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় বেরিয়ে এসেছে, শত শত প্রাণহানি ঘটেছে এবং দেশজুড়ে স্থাপনাগুলোর ক্ষতি হয়েছে, তবু ইসলামি প্রজাতন্ত্র ভেঙে পড়েনি; এমন কি এক বিশাল ইসরায়েলি হামলার মুখেও নয়।

ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র সঠিকভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে, ইরানের ভাবমূর্তি কলুষিত হয়নি (বরং বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ ইরানকে ইসরায়েলের আগ্রাসনের শিকার হিসেবে দেখেছে) এবং প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে ইরানের ওপর বড় কোনো সীমাবদ্ধতা চাপানো সম্ভব হয়নি। কাতারে অবস্থিত মার্কিন বিমানঘাঁটিতে ইরান হামলা চালায়। এর ‘প্রত্যাঘাত’ আসা ঠেকাতে আগেই ইরান তাদের হামলার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় এবং এর মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনে সফল হয়।

ইরান এতটাই শক্তিশালী প্রমাণিত হয়েছে যে, ট্রাম্পকে ইসরায়েলকে সতর্ক করতে হয়েছে যেন যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন না করে। ইরান শেষ পর্যন্ত ঠিক যেমন চায়, তেমনভাবেই এই যুদ্ধ থেকে বের হয়ে গেছে; নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নিয়ে সামনে এগোচ্ছে।

LIMON

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর