দীর্ঘ ৩৫ বছরের বাঁধা কাটিয়ে চাকসুর ‘ভোট উৎসব’ বুধবার

নিউজ ডেস্ক প্রকাশিত: ১৫ অক্টোবর ২০২৫ ০৩:১০ এএম

দীর্ঘ ৩৫ বছরের বাঁধা কাটিয়ে চাকসুর ‘ভোট উৎসব’ বুধবার

রাত পোহালেই অনুষ্ঠিত হবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন। দীর্ঘ ৩৫ বছরের বাঁধা কাটিয়ে প্রশাসনিক কাটিয়ে বুধবারের এই নির্বাচন ঘিরে ক্যাম্পাসজুড়ে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

ইতোমধ্যে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করার কথা জানিয়েছে চাকসু নির্বাচন কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

বুধবার (১৫ অক্টোবর) সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত একটানা চলবে ভোটগ্রহণ। সমাজ বিজ্ঞান, কলা ও মানববিদ্যা, ব্যবসায় প্রশাসন, আইটি ভবন ও বিজ্ঞান অনুষদের মোট ১৫টি কেন্দ্রে ৬০টি নির্বাচনী কক্ষ থাকবে। প্রত্যেকটি কক্ষে থাকবে পাঁচটি ব্যালট বাক্স।

চাকসু নির্বাচনের জন্য চারটি এবং হল সংসদের জন্য একটি ব্যলট বাক্স থাকবে। একটি কক্ষে ৫০০ জন ভোটার ভোট দিতে পারবেন। ভোট দেওয়ার জন্য প্রত্যেক ভোটার পাবেন ১০ মিনিট সময়। একজন ভোটার চাকসুতে ২৬টি ও হল সংসদে ১৪টিসহ মোট ৪০টি ভোট দেবেন।

 

চাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে মোট প্রার্থী ৯০৮ জন। এর মধ্যে শুধু চাকসুর ২৬টি পদে লড়বেন ৪১৫ জন প্রার্থী। চাকসুর সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে ২৩ জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ২২ জন, সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) ২১ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। সবচেয়ে বেশি প্রার্থী পাঁচটি নির্বাহী সদস্য পদে ৮৫ জন।

অন্যদিকে, ১৪টি হল ও একটি হোস্টেল সংসদে লড়বেন ৪৯৩ জন প্রার্থী। এর মধ্যে নয়টি ছাত্র হলের প্রার্থী ৩৫০ ও পাঁচটি ছাত্রী হলের প্রার্থী ১২৩ এবং হোস্টেল সংসদে প্রার্থী ২০ জন।

 

চাকসু নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, চাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ২৫ হাজার ৫২১ জন। এর মধ্যে ছাত্র ভোটার ১৬ হাজার ৮৪ জন এবং ছাত্রী ভোটার ১১ হাজার ৩২৯ জন শিক্ষার্থী ভোট প্রদান করবেন। সে হিসাবে, ছাত্র ভোটার শতকরা ৫৮.৪৭ শতাংশ এবং ছাত্রী ভোটার ৪১.১৭ শতাংশ। মোট ভোটারের ৭০ শতাংশই অনাবাসিক, বাকি ৩০ শতাংশ ভোটার থাকেন হল, হোস্টেল ও বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কটেজে।

 

এদিকে, শহরে থাকা প্রায় ৭০ শতাংশ ভোটারের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত সহজ করতে শাটল ট্রেনের অতিরিক্ত দুটি শিডিউল বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া, শহর থেকে ক্যাম্পাস যাতায়াতের জন্য থাকবে ১৫টি বিশেষ বাস।

 

১৫টি কেন্দ্রের পাশাপাশি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য চাকসু ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি বিশেষায়িত কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ভোটারদের ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে দুইজন নির্বাচন কমিশনার সার্বিক তত্ত্বাবধান করবেন।

 

নির্বাচন চলাকালে সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য পুলিশ, র‌্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীর অন্তত ১ হাজার ২০০ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া, প্রক্টরিয়াল বডির আওতায় আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২০ জন সদস্য।

 

নির্বাচনে ভোটগ্রহণের সময়  প্রতিটি অনুষদ ভবনে একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্বে থাকবেন। এছাড়া ট্রান্সপোর্টের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে চারজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।

 

অন্যদিকে, পুলিশ, এপিবিএন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম যৌথভাবে বহিরাগতদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে। এছাড়া, সার্বিক নিরাপত্তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনসিসি, রোভার স্কাউট, নিরাপত্তা দপ্তর, স্ট্রাইকিং ফোর্স, রিজার্ভ ফোর্স, ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা নিয়োজিত থাকবেন।

 

এদিকে, মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়েছেন। যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পর্যাপ্ত গোয়েন্দা কার্যক্রম চলমান আছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।

 

মঙ্গলবার সকালে ভোটের ব্যালট বাক্স প্রতিটি কেন্দ্রে আনা হয়েছে। চাকসু ভবন থেকে প্রতিটি অনুষদ ভবনের ভোট কেন্দ্রে পিকআপ গাড়িতে করে ব্যালট বাক্স নিয়ে যেতে দেখা গেছে।

 

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০ শতাংশ ভোটার ক্যাম্পাস থেকে ২২ কিলোমিটার দূরত্বের শহরে অবস্থান করছেন। ফলে অধিক দূরত্ব ও শাটলে যাতায়াত ভোগান্তির কারণে শহরে থাকা ভোটারদের আশানুরূপ উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রার্থীরা।

 

দুই-একটি প্যানেলের আপত্তি থাকলেও নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ভোট গণনা হবে আধুনিক ওএমআর পদ্ধতিতে। অধিক স্বচ্ছতার জন্য ভোট গণনা হবে দুই ধাপে। একটি হলো বাইরে থেকে আনা ভেন্ডর মেশিনের মাধ্যমে, অন্যটা আইসিটি সেলের প্রোগ্রামারের মাধ্যমে। যতক্ষণ পর্যন্ত দুইটির মাধ্যমের গণনা না মিলবে, ততক্ষণ ফলাফল ঘোষণা করা হবে না বলে জানিয়েছে কমিশন।

 

ভোটগ্রহণ শেষ হলে গোপন ভোটকক্ষ থেকে ব্যালট বাক্স প্রথমেই চলে যাবে প্রিজাইডিং অফিসারের কক্ষে। এরপর সব ব্যালট বাক্স রিটার্নিং অফিসারের কক্ষে জমা হবে। সেখানেই মূলত ভোট গণনার কাজ শুরু হবে। পাঁচটি অনুষদ ভবনের পাঁচজন ডিনের কক্ষে ভোট গণনার কাজ সম্পন্ন হবে।

 

নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে থাকবেন বিভিন্ন অনুষদের ডিন ও প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে থাকবেন বিভিন্ন বিভাগের সভাপতিবৃন্দ।

 

ভোটগ্রহণ থেকে ভোট গণনা পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া এলইডি স্ক্রিনে প্রদর্শন করা হবে। সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের ব্যবস্থা থাকায় এক মুহূর্তের জন্যও রেকর্ড বন্ধ হবে না বলে জানিয়েছে কমিশন।

 

সব কেন্দ্রের ভোট গণনা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ মিলনায়তনে চাকসু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হবে।

 

অবশ্য নির্বাচন ফলাফল ঘোষণা করতে কত সময় লাগতে পারে- এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা যায়নি। তবে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ৮ ঘণ্টা লাগতে পারে, আবার কমবেশিও হতে পারে। যতদ্রুত সম্ভব ফলাফল ঘোষণা করা হবে।

 

এ পর্যন্ত ছয়বার চাকসু নির্বাচন হয়েছে। প্রথম চাকসু নির্বাচন হয়েছিল ১৯৭০ সালে এবং সর্বশেষ ১৯৯০ সালে। দীর্ঘ েএই ৩৫ বছরে রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে কিন্তু জট খোলেনি চাকসু নির্বাচনের। আইনানুগ ছাত্রপ্রতিনিধিত্ব ছাড়াই চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়। সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকা দলগুলো মূলত ‘শিবিরভীতি’ থেকে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদের মতো চাকসু নির্বাচন নিয়েও কখনো সবুজ সংকেত দেয়নি।

 

চাকসুর শেষ দুই নির্বাচনের একটি হয়েছিল ১৯৮১ সালে। সেই নির্বাচনে ভিপি, জিএস, এজিএসসহ অধিকাংশ পদে বিজয়ী হয়েছিল ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল। শেষবার চাকুস ভোট হয় ১৯৯০ সালে। তাতে ছাত্রশিবিরের একক বিজয় ঠেকাতে গঠিত হয়েছিল সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য পরিষদ। ফলাফলে অধিকাংশ পদে বিজয়ী হয়েছিলেন এই পরিষদের প্রার্থীরা।

 

এবারো শিবিরের নিরঙ্কুশ বিজয় ঠেকাতে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য পরিষদ গঠনের চেষ্টা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবে রূপ নেয়নি।

 

নির্বাচনের সার্বিক বিষয়ে চাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন বলেন, “দীর্ঘ ৩৬ বছর পর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমরা নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে পারব বলে আমরা আশাবাদী।”

 

এআরএস

আপনার মূল্যবান মতামত দিন:

সম্পর্কিত খবর